জাতীয়
কোটা সংস্কার আন্দোলন: কুড়িগ্রামে ৩ লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি
কোটা সংস্কার আন্দোলনে কুড়িগ্রামের তিন যুবক ঢাকায় সংঘর্ষের সময় গুলিতে প্রাণ হারায়। তারা কেউ আন্দোলনের সাথে বা কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। তারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।
মৃতরা হলেন- উলিপুর উপজেলার ব্যাংক কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম (৩৫), কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার রাজমিস্ত্রী নুর ইসলাম (২২) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার রাজমিস্ত্রী গোলাম রব্বানী (২০)। এখন পর্যন্ত এই তিন পরিবারকে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেউ কোনো সহায়তা করেনি বলে জানা গেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম জেলার উলিপুর উপজেলার পৌর শহরের মুন্সিপাড়ার আব্দুর রশিদের একমাত্র সন্তান। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ। রায়হানুলের স্ত্রী রিতু আক্তার আর তাদের একমাত্র কন্যা রাওযা মনি (৪ মাস)। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রায়হানুল বাড়িতে আসে পরিবারের সাথে দেখা করতে। সব ঠিকঠাক, ঢাকার বাড্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবার নিয়ে সেখানে উঠবেন। এমন স্বপ্ন বুনে যান স্ত্রী রিতু আক্তারের মনে। এ দেখা যে শেষ দেখা হবে, এমন ভাবনা দুঃস্বপ্নেও দেখেনি পরিবারের কেউ। বাড়িতে কান্নার রোল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না কন্যা রাওযা মনি। হয়তো কোনো স্মৃতিই থাকবে না বাবাকে নিয়ে। সে তার মতোই অস্পষ্ট বাক্যে বলছেন নানা কথা। হাসছেন খেলছেন। অথচ কন্যার পাশে বসে দুচোখে অন্ধকার দেখছেন রিতু আক্তার। কী হবে তাদের আগামী জীবন। তিনি রাষ্ট্রের কাছে বিচার চান, চান ক্ষতিপূরণ।
বাবা আব্দুর রশিদ জানান, রায়হানুল ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষে চাকরি হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেখানে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতো। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে আরও বলেন, গত শুত্রুবার ১৯ জুলাই বাড্ডা এলাকায় জুম্মার নামাজ শেষে রাস্তায় নামলে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী আর পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়েন। এরই এক সময় একটি গুলি তার ডান চোখের কাছে লেগে পিছন দিয়ে বের হয়ে যায়। ফলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। ওইদিন রাত ১০টায় রওনা দিয়ে পরদিন শনিবার সকালে উলিপুরে লাশ পৌঁছে। সকাল সাড়ে ১১টায় এমএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে নামাজের জানাজা শেষে উলিপুর কেন্দ্রীয় কবর স্থানে দাফন করা হয়। তিনি পিতা হিসেবে খুব অসহায়ত্ব বোধ করছেন। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমার আর কোনো স্বপ্ন রইলো না।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ভাগিরভিটা গ্রামের আমির হোসেনের দুই পুত্রের মধ্যে নুর আলম বড়। বাবা আমির হোসেন ভ্যানচালক। আর মা নুর বানু গার্মেন্টস কর্মী। আর নুর আলম ছিলেন রাজমিস্ত্রী। সবার ছোট নুর জামাল (১৪) থাকতো অন্যের দোকানের কর্মচারী হিসেবে। নুর আলম প্রায় এক বছর আগে বিয়ে করেন। স্ত্রী খাদিজা অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের সবাই মিলে ভাড়া থাকতেন গাজিপুর চৌরাস্তার তেলিপাড়া এলাকায়।
বাবা আমির হোসেন প্রত্যক্ষদর্শী আশিক ও আব্দুল্লাহর বরাতে জানান, শনিবার (২০ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে ঠিকাদারের সাইডের কাজ থেকে ফেরার পথে চৌরাস্তা এলাকায় গোলাগুলিতে পড়েন। এক পর্যায়ে ডান চোখে গুলি লাগলে ঘটনাস্থলে লুটে পড়েন। পরে অন্যান্যরা ধরাধরি করে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. আবিদ বিল্লাহ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তারা লাশ নিয়ে যায় জয়দেবপুর সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে রাত ১০টায় লাশ হস্তান্তর করেন। পরদিন রবিবার গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসি। সকাল সাড়ে ১০টায় নামাজের জানাজা শেষে বাড়ির আঙ্গিনায় দাফন করা হয়।
মা নুর বানু বলেন, ‘আমার পোলা রাজনীতি করে না। কাজ করে খায়। আমরা গরিব মানুষ। আমার পোলার কী অপরাধ। তাকে গুলি করে মেরে ফেললো। এর কোনো বিচার নাই। আমি বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই। আমার বউমা ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার পোলাটা সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারলো না। কী হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের। নুর বানুর এমন প্রশ্ন আর কান্নায় ভাগিরভিটা গ্রামের বাতাস ভাড়ি হয়ে উঠে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিজিবির গুলিতে ঢাকার আফতাবনগরে মারা যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের কচাকাটা বাজার এলাকার সাইদুর রহমানের পুত্র গোলাম রব্বানী (২০)। নিহত গোলাম রব্বানীর সহকর্মী একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল ইসলাম (২২) জানান, তারা রামপুরা আফতাবনগরে থাকতেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় আফতাবনগরে ই-ব্লকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন তারা। এ সময় রাতের খাবার খেতে পাশের খাবারের দোকানে যাওয়ার পথে আকষ্মিক বিজিবির ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হন গোলাম রব্বানী। পেটের নিচে গুলি লাগে তার। তাকে দ্রুত পাশের একটি হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেন। পরে সেখান থেকে শ্যামলীর একটি হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে মরদেহ কুড়িগ্রাম নিয়ে আসে রাসেল ইসলাম।
গত শনিবার (২০ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় নাগেশ্বরীতে। রবিবার সকাল ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
রব্বানীর পিতা সাইদুর রহমান বলেন, আমার পোলাটা নিরাপরাধ। রাজনীতির সাথে পাছে নেই। ওর আয়ে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমাদের সংসার কেমনে চলবে। এ ঘটনার ন্যায়বিচার দাবি করেন তিনি।