জাতীয়রাজনীতি

ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস আজ, মুক্তির মহানায়ক ভাসানী

আজ ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা এ দিনে দেশের ছাত্র-জনতা অকাতরে বুকের রক্ত দিয়ে গণমানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।

শহর থেকে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেদিন লাখো কোটি মানুষের গগনবিদারী আওয়াজে ধ্বনিত হয় ‘১১ দফা’ আনতে হবে। মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের চোখেমুখে ছিল মুক্তির প্রত্যাশা। পথে পথে ছিল মিছিল। ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত উত্তাল দিনগুলোতে স্বৈরাচারী সরকারের বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিতে হয় আসাদ, রুস্তম, মনির, মতিউর, ড. জোহাসহ নাম না জানা অসংখ্য মানুষকে। কিন্তু এরপরও স্বৈরাচারের গদি রক্ষা পায়নি।

শহীদ আসাদ

পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এ দিনে সংগ্রামী জনতা শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকুমার ইন্সটিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। এর আগে ২০ জানুয়ারি শহীদ হন আসাদুজ্জামান।

আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র-জনতা যে ফুঁসে উঠেছিলেন, তার একটা যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে এ দিনে। এক সপ্তাহের দীর্ঘ আন্দোলনে ২৪ জানুয়ারি স্বৈরাচার সরকার পিছু হটে। সেই দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে ১৯৭০ সাল থেকেই এ দিনটিকে গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

গণঅভ্যুথান

 

মূলত ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। অন্তত একটি সাধারণ দাবি আইয়ুব খানের পতনের দাবিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পাকিস্তানের সব অংশের মানুষ একযোগে রাজপথে নামেন। বস্তুত, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালের সর্ববৃহৎ গণজাগরণ।

৬৮’র ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত গভর্নর হাউস ঘেরাও ও পরবর্তী দিনগুলোর কর্মসূচির মাধ্যমে। ৬ ডিসেম্বর ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’পালনের জন্য ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন এবং আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি যৌথভাবে পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে। জনসভার পর এক বিরাট মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। সেখানে জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হলে পরদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন মওলানা ভাসানী। ৮ ডিসেম্বর দুই ন্যাপ (ভাসানী ও মোজাফফর), আওয়ামী লীগ, পিপলস্ পার্টি, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামসহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর ডাকে গোটা পূর্ববাংলায় হরতাল পালিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ আহুত ‘নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’জোরেসোরে পালিত হয়। ১৪ ডিসেম্বরে ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর পাবনার ডিসির বাড়ি ঘেরাও করার মাধ্যমে ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃবৃন্দ ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। বস্তুত ১১ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে ছাত্র নেতৃবৃন্দ যে পদক্ষেপ নেন তা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি আন্দোলনগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এ সময় থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-সহ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পূর্ব বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ঊনসত্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মওলানা আব্দুল হাসিদ খান ভাসানীর সমাবেশ

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এক তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা, পরবর্তী সময় ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি মহান স্বাধীনতা অর্জন করে।

এদিকে দিবসটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দিনটি গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপ্রিয় আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা, পরবর্তীকালে ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা। পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close