৫ আগস্টের বিকেল। চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাতে অংশ নিয়েছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী মো. হৃদয়। সশস্ত্র কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘিরে ফেলেন তাকে। ইউনিফর্ম ও হেলমেট পরিহিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় সামনের দিক থেকে একজন পুলিশ সদস্য হৃদয়ের পেটে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ২০ বছর বয়সী হৃদয়। রাস্তায় নিথর পড়ে থাকে হৃদয়ের মরদেহ। পুলিশ সদস্যরা যে যার মতো চলে যান এ দিক ও দিক।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নেওয়ার পর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন গাজীপুরের কোনাবাড়ি থানা এলাকায় ঘটে এমন ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। সেই ভিডিওতেই পুলিশকে প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায় হৃদয়ের পেটে।
এ ঘটনার পর হৃদয়ের মরদেহের সন্ধান পায়নি তার পরিবার। ২০ দিন পর গত (২৬ আগস্ট) সোমবার নিহত হৃদয়ের ফুফাতো ভাই ইব্রাহিম বাদী হয়ে কোনাবাড়ি থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হককে।
আসামির তালিকায় আরও রয়েছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ১০-১২ জন অজ্ঞাত পুলিশসহ অজ্ঞাত ২৫০ থেকে ৩০০ জনকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। তবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে পাঁচ সাংবাদিককে এই হত্যা মামলায় আসামি করার বিষয়টি।
এজাহার থেকে জানা যায়, এই মামলার আসামির তালিকায় রয়েছেন— দৈনিক সমকালের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি এম তুষারী, বাংলা টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম, সকালের সময়ের কোনাবাড়ি প্রতিনিধি মোকলেছুর রহমান, ভোরের ডাকের গাজীপুর প্রতিনিধি এম এম মমিন রানা ও দৈনিক আজকালের কণ্ঠের গাজীপুর প্রতিনিধি মো. কবির হোসেন।
নিহত মো. হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর থানার উত্তর আলমনগর এলাকার মো. লাল মিয়ার ছেলে। টাঙ্গাইলের হেমনগর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। কোনাবাড়ি পারিজাত এলাকায় ফুফাতো ভাই মো. ইব্রাহিমের সঙ্গে থাকতেন তিনি। কোনাবাড়ি-কাশিমপুর সড়কে তারা দুজনই অটোরিকশা চালাতেন। আন্দোলন চলার সময় একটি দোকান ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন হৃদয়। সেখান থেকে ধরে নিয়ে তাকে পুলিশের প্রকাশ্যে গুলির ঘটনার ভিডিওই ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা বলছেন, মামলার বাদী ইব্রাহিম স্থানীয় নন। সে হিসাবে কোনো আসামিকেই তার চেনার কথা না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি চক্র পাঁচ সাংবাদিকের নাম আসামি হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
বাদী এজাহারে বলেন, ওই সময় সাবেক মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জন সন্ত্রাসী ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আমার মামাতো ভাই মো. হৃদয় প্রাণভয়ে পাশের একটি দোকানে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণ পরই অজ্ঞাত পুলিশ সদস্যরা তাকে দোকান থেকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে রের করে রাস্তায় নিয়ে যায়। পরে পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘেরাও করে আগ্নেয়াস্ত্র পেটে ঠেকিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ গুম করে। আমি ও আমার আশপাশের লোকজন সে ঘটনার ভিডিওধারণ করি।
সকালের সময়ের কোনাবাড়ি প্রতিনিধি মোকলেছুর রহমান বলেন, আমি কোনাবাড়ী প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। কোনাবাড়ি এলাকায় আমার বাড়ি। এর আগের কোনো সময়ে প্রকাশিত কোনো খবরের জের ধরে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার নামসহ অন্যদের নাম জড়িয়ে দিয়ে থাকতে পারে।
মোকলেছুর রহমান আরও বলেন, হৃদয় কীভাবে নিহত হয়েছে, সে ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে স্পষ্ট দেখা গেছে, পুলিশ গুলি করে ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে। সেখানে সাংবাদিকদের নাম কেন আসলো আসামি হিসেবে? গুলি করল পুলিশ, আসামি কেন আমরা?
গাজীপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রিপন শাহ বলেন, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের নাম মামলায় জড়ানো হয়েছে।’ এটিকে ‘মিথ্যা মামলা’ অভিহিত করে দ্রুত তা প্রত্যাহার করার দাবি জানান তিনি।
গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকারও মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের নামে এমন মামলার তীব্র নিন্দা জানাই। প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা হোক। একটি চক্র সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট করার চক্রান্ত করে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে কথা বলতে বাদী ইব্রাহীমের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস করেও তার কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আহামারুজ্জামান বলেন, কেউ দায়ী না থাকলে তাকে গ্রেফতার করা হবে না। তদন্ত করে দায়ীদের গ্রেফতার করা হবে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মো. জিয়াউল হক বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ ছাড়া কোনো আসামিকে হয়রানি করা হবে না।