জাতীয়ঢাকাঢাকা বিভাগরাজনীতি

জামিন নাকচ, মির্জা ফখরুল কারাগারে

রোববার সকালে বিএনপির ডাকা হরতালের মধ্যে মির্জা ফখরুলকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।

ঢাকার মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন রোববার রাত ১০ টায় বিএনপি মহাসচিবের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর এই আদেশ দেন।

ফখরুলের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী, মোসলেহ উদ্দিন জসিম, খোরশেদ আলম মিয়া, সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ, গোলাম মোস্তফা ও মহসীন মিয়া। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু। ফখরুলকে এ মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার কোনো আবেদন পুলিশের পক্ষ থেকে করা হয়নি। সে কারণে তাকে এজলাসেও তোলা হয়নি। শুনানির আধা ঘণ্টা আগে তাকে কোর্ট হাজতে রাখা হয়।

ফখরুলের আইনজীবীরা তাকে কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন করেছিলেন। বিচারক এ বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

রোববার সকালে বিএনপির ডাকা হরতালের মধ্যে মির্জা ফখরুলকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। সারা দিন তাকে রাখা হয় ডিবি কর্যালয়ে।

সাংবাদিকরা সারাদিন সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন ফখরুলকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা জানার জন্য। সেই তথ্য মেলে সন্ধ্যার পর।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন রাত সাড়ে ৮টায় সাংবাদিকদের জানান, শনিবার সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিএনপি মহাসচিবকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

এর কিছুক্ষণ আগে বিশেষ পুলিশ প্রহরায় একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেওয়া হয় ফখরুলকে। সেখানে তাকে হাজতখানায় রাখা হয়।

জামিন শুনানিতে ফখরুলের আইনজীবী ফারুকী বলেন, “তিনি রাজনীতিতে স্বচ্ছ ব্যক্তি, তার কোনো বদনাম নেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, অনেক রকম অসুখে আক্রান্ত, ভালোভাবে হাটতে পারেন না।”

সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বিচারককে উদ্দেশ করে বলেন, “আদেশ কী দেবেন জানি। সে কারণে কারাগারে তার সুচিকিৎসা, আর প্রথম শ্রেণির মর্যাদার আবেদন দিয়েছি। দয়া করে বিবেচনা করবেন।”

এ কথায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শোরগোল ওঠে। তারা এ কথার প্রতিবাদ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন বলেন, “এখনো শুনানি শুরুই হল না, আপনি নিজেই আদেশ দিয়ে ফেললেন!”

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, এজাহারে যে ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে, তার দুই কিলোমিটার দূরে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে মঞ্চে ছিলেন ফখরুল। অথচ বলা হচ্ছে তিনি হামলা করেছেন প্রধান বিচারপতির বাড়িতে।

তখন বিচারক বলেন, “আপনি এজাহার আর আদালতে আসামি পাঠানোর প্রতিবেদন দেখে কথা বলছেন?”

আইনজীবী ফারুকী তখন বলেন, “দেখে কথা বলছি।” পরে তিনি জামিনের অন্য যুক্তি তুলে ধরেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করে। আবদুল্লাহ আবু বলেন, “দূরত্ব বিষয় নয়। সশরীরে ফখরুল সাহেব উপস্থিত ছিলেন এমন কথা বলা হয়নি মামলায়।

“বলা হয়েছে যে তিনি নির্দেশদাতা। এমন একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হত্যা, গাড়ি পোড়ানো, গুলি করা এগুলো কি শান্তির উপাদান?

দুই পক্ষে শুনানি নিয়ে আদালত জামিন নাকচ করে আদেশ দেন। শুনানির সময় দুই পক্ষে উত্তেজনা, বাদানুবাদ চলে। জামিন নাকচ হয়ে গেলে ফখরুলকে পাঠানো হয় কারাগারে।

শনিবার সংঘর্ষের সময় নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের মঞ্চের সামনে আগুন ধরিয়ে দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

 জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘সরকার পতনের’ এক দফা দাবিতে শনিবার সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। ২০ শর্তে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ।

শনিবার দুপুরের আগে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শুরুর পর কাছেই কাকরাইল মোড়ে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। শান্তিনগর, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ এবং দৈনিক বাংলা মোড় এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়।

সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হয় আরো ডজনখানেক যানবাহন। হামলা করা হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে।

দৈনিক বাংলা মোড়ে পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘাতে প্রাণ যায় যুবদলের মুগদা থানার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা শামীম মোল্লার।

সংঘর্ষের মধ্যে পণ্ড হওয়া সমাবেশ থেকেই রোববার সারাদেশে হরতালের ডাক দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার গুলশানের বাসায় যায় গোয়েন্দা পুলিশ।

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। রোববার সন্ধ্যায় তাকে আদালতে নেওয়া হলে সেখানে আসেন তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম।

ফখরুলকে আটকের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম পরে সাংবাদিকদের বলেন, “ওরা (পুলিশ) সকালে এল। ওই সময় আমরা চা খাচ্ছিলাম। এসে প্রথমে বলল যে, স্যার আপনার সাথে কথা বলব। কিছু কথাবার্তা বলে নিচে চলে গেল । বলল যে, ‘স্যার আপনার সাথে কথা বলার জন্য আসছিলাম।’ যাওয়ার সময়ে তারা বাসায় ভেতরের সিসি ক্যামেরার ডিভাইস (হার্ড ডিস্ক) এবং অ্যাপার্টমেন্টের নিচের সিসি ক্যামেরার ডিভাইস নিয়ে গেছে।

“আমার যতটুকু ধারণা, তারা নিচেই ছিল। ১০ মিনিট পরে আবার এল যে, ‘স্যার আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে’। যা বলে প্রত্যেকবার… ‘স্যার উপরের অর্ডার আছে’।”

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানার মামলায় গ্রেপ্তার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে রোববার রাতে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, শনিবারের সংঘাতের ঘটনায় ঢাকার ২১টি থানায় ২৮টি মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৯৬ জনকে।

এর মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার পাশাপাশি পুলিশ হত্যা মামলাতেও আসামি করা হয়েছে মির্জা ফখরুলকে। পল্টন থানার ওই মামলায় বিএনপি মহাসচিবকে করা হয়েছে ১ নম্বর আসামি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ঘটনা অনেকগুলো ঘটেছে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে, এ মামলা তো হবেই। আমরা শনাক্ত করছি, যারা যারা এখানে ঢুকেছিলেন, যার যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদেরকে অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে।

“প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আক্রমণ হল, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? পুলিশ নিহত হল, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? পুলিশের তিনটি অস্ত্র তারা জোর করে নিয়ে গেছে, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন?”

আর ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার নিজ কার্যালয়ে বলেন, “পুলিশকে যারা হত্যা করেছে, যারা প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা চালিয়েছে, পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সসহ গাড়ি পুড়িয়েছে, পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। “এসব ঘটনায় যত উচ্চ পর্যায়ের হোক আর যত নিম্ন পর্যায়ের হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close