রুপগঞ্জ

নতুন রূপে রূপগঞ্জে ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান

আলোচিত ক্যাসিনোকাণ্ডের অন্যতম হোতা সেলিম প্রধান। দীর্ঘ কারাভোগের পর নতুন রূপে ফিরে এসেছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শনিবার (২১ অক্টোবর) দিনভর তিনি বেশ কয়েকটি পূজামন্ডপ ঘুরে ঘুরে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন এলাকাবাসীর মধ্যে। কোলেরর শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষদের বলছেন রূপগঞ্জকে তিনি পাল্টে দিতে চান। কাউকে কোন খারাপ কাজ করতে দিবেন না। এমপি নির্বাচনও করবেন না। তিনি গরীব-নিরিহ মানুষের পক্ষে থাকবেন। তার এমন কথা আর আচরনে এলাকার মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রূপগঞ্জে সেলিম প্রধানের আকষ্মিক বিচরণ নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে।

রূপগঞ্জে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন সেলিম প্রধান।
ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান শনিবার সংবাদিকদের বলেন, আমি রূপগঞ্জকে পরিবর্তন করবো, আপনাদের সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছি। তবে আমি রাজনীতি করবো না, এমপি নির্বাচনও করব না। অনেক দিন পর আমি এলাকায় এসেছি। আমার এলাকায় অনেক ভালো কাজ হয় আবার খারাপ কাজও হয়। রূপগঞ্জ উপজেলাকে পরিবর্তন করতে বাকি জীবন এলাকাতেই থাকব, সময় কাটাব।

তিনি আরও বলেন, রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই। এটা এক ধরনের জব। আমি চাই মানুষ যা চায় তা যেন পায়। জনগণ মনে করেন আমি ভোটটা দিলাম আপনারা আমাদেরকে দেখবেন। অথচ ভোট পাওয়ার পরে গরীব নিরীহ মানুষের খবর আর কেউ নেয় না।

কে এই সেলিম প্রধান
ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকায়। এলাকায় তাঁদের বাড়িটি ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত।। সেলিম প্রধানের বাবা নান্নু মিয়া ভুলতায় একসময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন।

স্থানীয়দের তথ্যমতে, সেলিম প্রধানের বাবা একসময় ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। এর পর থেকে এলাকার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের যোগাযোগ খানিকটা কম। নান্নু মিয়ার তিন ছেলে, তিন মেয়ের জনক। ছেলেদের মধ্যে সেলিম তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। নান্নু মিয়া ১৯৮৮ সালে তাঁর বড় ছেলে আলম মিয়াকে জাপান পাঠান। বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সেলিম প্রধানও পরে জাপানে চলে যান। সেখানে তিনি পড়াশোনা ও কাজ করতেন। জাপানি এক নারীকে তিনি বিয়ে করেন।

মর্তুজাবাদে সেলিম মিয়ার প্রতিবেশীদের তথ্যমতে, জাপানে থাকার সময় সেলিম প্রধান তাঁর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাঁর ব্যবসার প্রসার আরও বাড়তে থাকে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের জেবি সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেলিম প্রধান ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি পি-২৪ নামে ল ফার্মেরও মালিক। পি-২৪ নামে অনলাইন ক্যাসিনোর জন্য একটি অ্যাপস রয়েছে।

গ্রেপ্তার ও কারাভোগের কাহিনী
সেলিম প্রধান চার বছর আগে গ্রেপ্তার হন র‌্যাবের হাতে। এরপর একে একে চারটি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দুদকের মামলায় তাকে দুই ধারায় চার বছর করে মোট আট বছরের সাজা দেন আদালত। তবে উভয় সাজা একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ওই মামলায় চার বছর সাজা খাটা শেষ। বাকি তিন মামলায় জামিনে থাকায় এরই মধ্যে মুক্তি পান তিনি।

সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। এরপর তার গুলশান, বনানীর বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত।

তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আমিরুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। বৈদেশিক মুদ্রা আইনের আরেক মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত সে মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে র‌্যাব বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মো. শহিদুল ইসলাম খান ৬ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে সেটি সিআইডির তদন্তাধীন। এ মামলায়ও তিনি জামিনে রয়েছেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর সেলিমের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত করে শেষ পর্যন্ত ৫৭ কোটিরও বেশি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার বিশেষ আদালত-৮-এর বিচারক বদিউল আলম মানি লন্ডারিং আইনে ৪ বছরের কারাদ- ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদক আইনে ৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা এবং অনাদায়ে আরেক মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত: ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের দখলে থাকা রূপগঞ্জের ভুলতা-গোলাকান্দাইল চার তলা বিশিষ্ট ফ্লাইওভারের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অংশের সওজের জমি উদ্ধার করেছে প্রশাসন। ওই দিন সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী যুগ্মসচিব এবং সড়ক ও জনপদ (সওজ) অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুর রহমান ফারুকীর নেতৃত্বে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং লিমিটেডের অবৈধ দখলে থাকা ১৫ শতাংশ জমির পাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগমের সহায়তায় আরো বেশ কয়েকটি দোকান ঘরসহ পাকা স্থাপনা ভেঙে দখলমুক্ত করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close