বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন হত্যায় পুলিশ জড়িত নয় বলে প্রতিবেদন দিয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি। অভিযোগ উঠেছে, তিন তদন্ত কর্মকর্তা তাদের পুলিশ সহকর্মীদের বাঁচাতে পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন দিয়েছেন। একই সাথে ইয়ামিনকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করেছে। কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনার আমলে পুলিশের যে নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের পরেও তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং, কঠিন চাপে থাকলেও মাঝে মাঝে তাদের নষ্ট চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।
জানা যায়, নির্মম ওই হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ৭৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন শহীদ ইয়ামিনের মামা মো. আব্দুল্লাহ আল মুন কাদির। এরপর শুরু হয় তদন্ত। প্রতিবেদনে পুলিশের সাক্ষ্যে বলা হয়েছে, ইয়ামিন এপিসি কারে উঠলে বাইরে থেকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে। এতে সে কারের (সাজোয়া যান) উপরে লুটিয়ে পড়ে। এএসআই মোহাম্মদ আলী ছাদ থেকে নামাতে গেলে হাত ফসকে পড়ে যায় ইয়ামিন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তার হাতে ব্যথা ছিলো। চিকিৎসার জন্য রোড ডিভাইডার পার করে দেয়, যেনো ইয়ামিনকে জনগণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে।
পুলিশের এই বক্তব্যের সাথে ভিডিও ফুটেজের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে আন্দোলনকারীদের ভয় দেখাতে ইয়ামিনকে নীল রঙের এপিসি কারের ওপর রেখে সড়ক টহল দেয় পুলিশ সদস্যরা। একই সাথে চলে ছাত্র-জনতার উপর গুলি। কিছুক্ষণ পর এপিসির অবস্থান বদলে সাভারের রানা প্লাজা ও ভ্যাট অফিসের মাঝামাঝি এলাকায় আসে। সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে পুলিশের এক সদস্য বাম দিকের দরজা খুলে দেন। তখন আরেকজন পুলিশ সদস্য এপিসির ওপরের ঢাকনা খুলে ওপরে উঠে ইয়ামিনকে টেনে-হিচড়ে সড়কে ফেলে দেন। ওই সময়ও ইয়ামিন জীবিত ছিল। গুলিবিদ্ধ শাইখ ইয়ামিনকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড কষ্টে নিশ্বাস নিতে দেখা যায় তখনও। তার পরনে ছিল একটি নেভি ব্লু রংয়ের ট্রাউজার এবং গায়ে অনেকটা খয়েরি রঙের জামা। এপিসি থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হলে তার দুই হাত দুই দিকে পড়ে। আর একটি পা ভাজ হয়ে পড়ে। আরেক পা এপিসির বাঁ দিকের চাকার সঙ্গে আটকে যায়। মৃত ভেবে পায়ে গুলি না করে রাস্তার ওপরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে রোড ডিভাইডারের পাশে ফেলে দেন। এরপর আরও দুইজন পুলিশ সদস্য এপিসি থেকে নেমে তাকে মূল সড়ক থেকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলে দেয়।
পুলিশের এই প্রতিবেদনে গভীর বিস্ময় প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চরম পক্ষপাতদুষ্ট এ প্রতিবেদন অগ্রহণযোগ্য। আর শহীদ ইয়ামিনের প্রতি পুলিশের এমন আচরণকে ‘ভয়ংকর বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ’ বলে প্রতিবেদন দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বাংলাভিশনকে জানিয়েছে, পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভায় আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ইয়ামিন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপের কোনো মিল নেই। ফলে, প্রতিবেদনটির নির্ভুলতা ও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়াও, তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুধু পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য নিয়েছেন। তারা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী জনগণ কিংবা সংবাদকর্মীর সাক্ষ্য নেননি, যা তদন্ত প্রক্রিয়াকে পক্ষপাতদুষ্ট ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা তদন্তকালে অপেশাদারসুলভ কর্মকাণ্ডসহ দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন। এ প্রেক্ষিতে কমিটির তিন পুলিশ সদস্য তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পেশাদারিত্বের সঙ্গে পালন না করায় এবং দায়িত্বে চরম অবহেলা করায় তাদের চাকরি হতে বরখাস্ত করাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখাকে অনুরোধ জানানো হলো।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের সাঁজোয়া যান এপিসি থেকে ইয়ামিনের গুলিবিদ্ধ দেহ রাস্তায় ফেলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পুলিশ। সাভারের আশুলিয়া এলাকায় বর্বরোচিত ওই ঘটনা ঘটে। কোনোরূপ মৃত্যুর সনদ না দিয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইয়ামিনের লাশ হস্তান্তর করে। ঢাকা ও সাভার রেঞ্জের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইয়ামিনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের না করতে ভয়ভীতি দেখান। সাভারের তালবাগে পারিবারিক কবরস্থানে ইয়ামিনের লাশ দাফন করতে চাইলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান মিজান বাধা দেন। পরে, শহীদ ইয়ামিনকে সাভার ব্যাংক টাউন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।