আইন ও অধিকারজাতীয়
গুলি ও গ্রেফতারের ঘটনায় ১৭ জনের ‘গণতদন্ত কমিশন’ গঠন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় ‘দুই শতাধিক’ মৃত্যু এবং আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, গুলি ও গণগ্রেফতারের ঘটনায় শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষার্থীর অভিভাবকসহ দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সোমবার (২৯ জুলাই) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে ‘গণহত্যার বিচার ও গায়েবী মামলায়-গ্রেফতার ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে এক আইনজীবী সমাবেশে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১৭ সদস্য বিশিষ্ট গণতদন্ত কমিশনে সভাপতি হিসেবে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন ও আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। এ ছাড়া যৌথভাবে সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করবেন অধ্যাপক তানজিমুদ্দিন খান ও লেখক গবেষক মাহা মির্জা।
কমিশনের সদস্যরা হলেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাইয়িদ খান, ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন, সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, আইনজীবী অনীক আর হক, অধ্যাপক তানজিমুদ্দিন খান, লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা।
এ ছাড়াও গণতদন্ত কমিশনে উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তোবারক হোসেন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যপক সলিমুল্লাহ্ খান, শিক্ষক কাজী মাহফুজুল হক সুপন, আইনজীবী রাশনা ইমাম, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টে সোমবার দুপুরে গণহত্যার বিচার ও গায়েবি মামলায়-গ্রেফতার ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে আইনজীবী সমাজের ব্যানারে অনুষ্ঠিত আইনজীবী সমাবেশে বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সারা হোসেন, তোবারক হোসেন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অনীক আর হক, মাহবুবুর রহমান খান, জামিউল হক ফয়সাল, মানজুর আল মতিন প্রমুখ।
আইনজীবী সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্না বলেন, ‘ছাত্রদের ৮ দফা দাবি খুবই যৌক্তিক ছিল। এই ছাত্ররাই কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুরু করে ছিল বটতলা থেকে। পাকিস্তান আমল থেকে আজকে পর্যন্ত দেখিনি একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি দাবি নিয়ে এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে ব্লক রেইড করে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হবে কোন অধিকারে? কোন আইনে এই অধিকার দিয়েছে। আমরা ধিক্কার দেই। যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। পদে পদে সরকার তা বরখেলাপ করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এটি সহিংসতা-হত্যার ঘটনা জাতির জন্য কলঙ্ক হয়ে থাকবে। এই বিচারের জনগণের ওপর দিলাম। আমরা আইনজীবী হিসেবে একটা গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছি। যেটি তদন্ত করে দেখবে। আমরা ছাড়ব না। আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাব।’
গণমাধ্যমে দেওয়া গণতদন্ত কমিশনের লিখিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- গত ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়ে সহিংসতার সূত্রপাত হয়। বিশেষ করে এই সহিংসতার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশ জুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এলে রংপুরে আবু সাইদকে সরাসরি বুকে গুলি করা হয়। কিন্তু পুলিশ যখন মামলা দায়ের করে তখন সাধারণ ছাত্র এবং জনগণকে দায়ী করা হয়। এতে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে এবং এইসব ঘটনায় সত্য উদঘাটনের দাবি উঠেছে। এ ঘটনায় পত্রিকার হিসেবে অন্তত ২০৯ জনের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ হলেও, সরকারি হিসেবে তা ১৪৭ জন (২৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদে হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ১৫০ জন)।
আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, গুলি ও গণগ্রেফতারসহ নানা সহিংস উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং তাতে সংবিধান, প্রচলিত আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
তাই এসব ঘটনার কারণ উদঘাটন, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আবশ্যকতা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে, দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, সংস্কৃতি কর্মী ও সাধারণ অভিভাবকেদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
তাই জাতীয় গণ তদন্ত কমিশনের পক্ষ থেকে সকল সচেতন ব্যক্তিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১ জুলাই থেকে সংগঠিত বিভিন্ন সহিংস নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, গুলিবর্ষণ, হুমকি, মামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় তথ্য কমিশনের কাছে পাঠানোর জন্য শিগগিরই অনুরোধ জানানো হবে। অডিও, ভিডিও, ফটোগ্রাফ, লেখালেখিসহ যেকোনো ধরনের তথ্য পাঠানো যাবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৮ ও ১৯ জুলাই। এ সময় দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, বনানীর সেতু ভবন, মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হাসপাতাল, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া মিরপুর-১০ নম্বর ও শেওড়াপাড়ায় মেট্রোরেল রেল স্টেশনেও ভাঙচুর চালানো হয়।
সহিংসতার কারণে গোটা দেশে বন্ধ হয়ে পড়ে ইন্টারনেট সংযোগ। অবশ্য পাঁচদিনের মাথায় চালু হয় ব্রডব্যান্ড সংযোগ। ১০ দিনের রোববার (২৮ জুলাই) চালু করা হয়েছে মোবাইল ইন্টারনেট। তবে ফেসবুক টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বন্ধ রয়েছে।
সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে দোষীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককেও।
ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ক গতকাল লিখিত বক্তব্যে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সমন্বয়কদের একাংশ।