জাতীয়
গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে প্রস্তাব
বাংলাদেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
নতুন যে দাম নির্ধারণের প্রস্তাব তারা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে, তা বর্তমান মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ।
মোট পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে।
তবে এ আবেদন নিয়মমাফিক না হওয়ায় বিইআরসি তা ফেরত পাঠিয়েছিল। এরপর আবার দুইটি কোম্পানি একই রকম প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল জলিল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন,”প্রস্তাব করার জন্য আমাদের যে আইন ও প্রবিধান রয়েছে, তাদের আবেদনগুলো সেই নিয়ম অনুযায়ী হয়নি বলে আমরা ফেরত পাঠিয়েছিলাম। তবে আজ আবার দু’টি কোম্পানি কাগজপত্র ঠিক করে প্রস্তাব জমা দিয়েছে।”
”এখন আমাদের মূল্যায়ন কমিটি এগুলো যাচাই করে দেখবে। প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে সব পক্ষকে নিয়ে গণশুনানি হবে। দাম বাড়বে কিনা, কী হবে – তা গণশুনানিতেই ঠিক হবে,” তিনি বলছেন।
সরকার বলছে, বাংলাদেশের গ্যাস ক্রমেই আমদানি করা এলএনজি নির্ভর হয়ে ওঠায় মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প নেই।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। আবার কারও মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে দাম সমন্বয় করতে হবে।
তবে সাধারণ ভোক্তাদের আশঙ্কা, বিদ্যুৎ, তেলের পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে।
গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব
ধানমণ্ডির একজন বাসিন্দা জিনিয়া রহমান পাইপলাইনের গ্যাসে দুই চুলা ব্যবহার করেন। এজন্য প্রতিমাসে তাকে ৯৭৫ টাকা দিতে হয়।
নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রায় অভিন্ন যে প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো, তাতে আবাসিক গ্রাহকদের ঘনমিটার প্রতি ৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থাৎ জিনিয়া রহমানের দুই চুলার জন্য দিতে হবে দুই হাজার ১০০ টাকা।
”এমনিতেই বাজারের সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। শাকসবজি, চাল, পরিবহন, বিদ্যুৎ, পানি- সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এখন যদি গ্যাসের দামও এতো বেড়ে যায়, তাহলে তো রান্নাবান্নাই বন্ধ করে দিতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন জিনিয়া রহমান।
যদিও গ্যাসের প্রিপেইড মিটারে তুলনামূলক কম খরচ হয়। যেমন মিরপুরের ইলোরা চৌধুরীর এক হাজার টাকার একটি প্রিপেইড কার্ডে তিন মাস চলে যায়। কিন্তু তার আশঙ্কা, নতুন করে দাম বাড়ানো হলে তার খরচও দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
”এখন আমার যে খরচ হয়, তখন নিশ্চয়ই তার দ্বিগুণ খরচ হবে। হয়তো সেটার জন্য আমাকে আবার অন্য বাজেট কাটছাঁট করতে হবে,” বলছেন মিসেস চৌধুরী।
কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রায় অভিন্ন যে প্রস্তাব করেছে, সেখানে ক্যাপটিভে (শিল্পকারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস) ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সিএনজিতে ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫-৭৬ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তাগিদ দেয়ার পর তেসরা জানুয়ারি জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে পাঠানোর জন্য পেট্রোবাংলাকে তাগিদ দেয়।
এরপর পেট্রোবাংলা থেকে এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দাম, ভ্যাট-ট্যাক্স, অন্যান্য চার্জ ধরে একটি খসড়া হিসাব বিতরণ কোম্পানিগুলোতে পাঠানো হয়। কোম্পানিগুলো তার ভিত্তিতে নিজেদের পরিচালন ব্যয়, লাভ যোগ করে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিশনে পাঠিয়েছে।
কেন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব?
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দেয়া প্রস্তাবে কোম্পানিগুলো যুক্তি দিয়েছে যে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা, সরবরাহ, পরিচালন ব্যয় ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের খরচ বেড়ে গেছে।
আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে তারা বলেছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”সরকার যে গ্যাস আমদানি করছে, সেখানে গ্যাসের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে। সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেজন্য ফাইন্যান্স (অর্থ মন্ত্রণালয়) থেকে বলা হয়েছে, দাম সমন্বয় করতে হবে।”
তিনি জানান, বিইআরসিতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তারপর তারা শুনানি করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে নাকি হবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব যে গ্যাস রয়েছে, তার বড় একটি অংশ সরকার বিদ্যুৎ ও সার শিল্পে ব্যবহার করে। ফলে আবাসিক ও বেসরকারি খাতে যে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, সেটা মেটাতে হচ্ছে বেশি দামে আমদানি করা গ্যাস দিয়ে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ওঠানামা করার কারণে সরকারকেও সেই আমদানি করা গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে আবাসিক, যানবাহন ও শিল্পখাতের গ্যাসের দাম বাড়াতে চাইছে সরকার।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক?
এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত কিনা, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তার মধ্যে ২ হাজার ৩০০ ঘনফুট গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস আমদানী করা হয়।
তার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কেনা হয় ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ৬ থেকে ১০ ডলার মূল্যে। স্পট মার্কেট থেকে বাকি ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস কেনা হয়, যেটির দাম ওঠানামা করে।
ফলে এই স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের জন্য এখনই এতো বেশি মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আমাদের নিজস্ব যে গ্যাসটা ছিল, সেটা তো প্রায় ফুরিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে আমরা এলএনজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। আমাদের গ্যাসের দাম ২ থেকে ৩ ডলার পড়তো। কিন্তু আমদানি করা গ্যাসের দাম পড়ছে ৯ ডলারের বেশি। যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের কিন্তু সেই দামী গ্যাসের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে যেতে হচ্ছে।”
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস ফুরিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন পুরোপুরি আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দামের সাথে সমন্বয় করতে গিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ গ্যাসের দাম পাঁচগুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
তবে আরেকজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ বলছেন, ”এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো একেবারেই যৌক্তিক না। দেশের ভেতরে যে গ্যাস রয়েছে, সেটা সরকার তোলে না। বরং বিদেশ থেকে আমদানির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। একটা চক্রকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে, বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে।
”কেন কোম্পানিগুলো দুইগুণ-তিনগুণ বাড়াতে চাইছে, আমরা সেটা জানি না। হয়তো সরকারকে তারা পরোক্ষভাবে আগামীতে যে এলপিজি আসবে, সেই দামকে সাপোর্ট করার জন্য তারা দামটা বাড়িয়ে নিচ্ছে,” – বলছেন মি. রহমতউল্লাহ।
তিনি বলছেন, গত কয়েক বছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তার মানে আগে থেকেই গ্যাসের দাম বেশি করে আদায় করছে সরকার।
তিতাস গ্যাস কোম্পানিও বিইআরসিতে যে হিসাব জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে গত চার বছরে কোম্পানিটি ১৪০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ আশঙ্কা করেন, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য হয়তো এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি, মজুদ, সরবরাহ বেশিরভাগ বেসরকারি খাতে হয় বলে এই ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
বরং গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস আহরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, ”আমাদের এখানে অনুসন্ধান তো করছিই। নিজেদের থাকলে কেন আমরা বাইরে থেকে আমদানি করবো? কিন্তু আমাদের দেশে তো এতো গ্যাস নেই, যে সারাজীবন পাওয়া যাবে। চাহিদা বেড়ে গেছে, প্রচুর শিল্প হয়েছে, রপ্তানি বেড়েছে- এতো চাহিদা, গ্যাস দেবো কোথা থেকে? বাধ্য হয়েই আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে। ”
অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কিছুটা প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা অনেক বেশি।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, এখনি পুরোপুরি গ্যাস আমদানির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের উচিত অভ্যন্তরীণ উৎস খুঁজে বের করা এবং উৎপাদন করা। তাহলে হঠাৎ করে জনগণ ও শিল্পের ওপর চাপ না দিয়ে দামটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে।