কুমিল্লাচট্টগ্রাম বিভাগরাজনীতি

কুমিল্লায় মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই নির্বাচনি প্রচারণায় মেয়র সাক্কু!

২৫ এপ্রিল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ১৫ জুন নির্বাচনকে সামনে রেখে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বাড়ছে প্রার্থীদের কর্মতৎপরতা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে একডজনের বেশি প্রার্থী ফরম কিনলেও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাতকে দলের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। এরইসঙ্গে কুসিকের নাগরিকদের মধ্যেও চলছে প্রার্থীদের নিয়ে নানা আলোচনা। নগরজুড়ে প্রশ্ন— কে হতে যাচ্ছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী? পরপর দুইবারের কুসিক নির্বাচনে জয়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু নির্বাচন করছেন তো?

এমন অবস্থায় সরেজমিনে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া না হলেও প্রতীক বরাদ্দের আগেই নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছে মনিরুল হক সাক্কুর কর্মী-সমর্থকরা। পোস্টার, লিফলেট বিলি বা মাইক ব্যবহার করে নয় বরং কুসিক ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়র সাক্কুর পক্ষে ভোট চাইছেন।

মনোনয়নপত্র দাখিলের পরে ও প্রতীক বরাদ্দের আগে এভাবে প্রচারণা আইনবিরুদ্ধ বলে জানিয়েছেন কুসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই এমন প্রচারণাকে নির্বাচনের মাঠে অনৈতিক বলে মনে করছেন সরকারি দল মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি মনিরুল হক সাক্কু।

রোববার (১৫ মে) সরেজমিনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের পাঁচ নং ওয়ার্ডের মোগলটুলী, গাংচর সংলগ্ন এলাকায় বিকেল ৪টার দিকে একদল মহিলা কর্মীকে দেখা যায় নির্বাচনি প্রচারণায়। এ সময় তারা মোগলটুলী-গাংচর সংলগ্ন বিভিন্ন বাসায় গিয়ে ভোট চাইছিলেন মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর জন্য।

ভোটার হিসেবে কথা বলতে চাইলে তারা প্রতিবেদককে মেয়র পদে মনিরুল হক সাক্কুকে ভোট দেওয়ার কথা অনুরোধ জানান।

প্রতিবেদক নিজেকে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা জানান, মেয়র পদে মনিরুল হক সাক্কুর জন্য ভোট চাইতে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন বাসায় গিয়ে ভোট চাইছেন তারা। রাবেয়া নামে একজনের নেতৃত্বে তারা ভোট চাওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানান।

ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এলাকাগুলোতে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন বলেও জানান তারা।

মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার রাজিবুল হায়দার বলেন, একটু আগে তারা বাসায় আসে। মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে চান তারা। এ সময় তারা মনিরুল হক সাক্কুর জন্য ভোট চান ও দোয়া করতে বলেন।

এ সময় প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ফোন ধরেন নাই।

বিভিন্ন এলাকায় আপনার পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতীক বরাদ্ধের আগেই এমন প্রচারণাকে কিভাবে দেখছেন?— খুদে বার্তার মাধ্যমে এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলেও কোনো উত্তর দেন নি।

এর আগে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, মেয়র হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ হবে ১৬ মে। এরপরেই ১৭ মে আমি আমার মনোনয়নপত্র জমা দেবো মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের জন্য। টানা দুই মেয়াদে মেয়র থাকাকালীন সময়ে আমি চেষ্টা করেছি নাগরিকদের জন্য কাজ করার ও সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের জন্য।

তিনি বলেন, আমি অতীতেও বিএনপি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নির্বাচন করেছি। যেহেতু বিএনপি নির্বাচন করবে না তাই জনগণের দাবির প্রেক্ষিতেই প্রার্থী হয়েছি আমি। যেহেতু জন্মের পর থেকেই এই রাজনৈতিক দলের আদর্শে আমি রাজনীতি করেছি তাই আমার তো আর অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

তিনি আরও বলেন, জনগণের স্বার্থে আমাকে নির্বাচন করতে হবে। দুই টার্মে আমি সরকার থেকে সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা পেয়েছি। এ দিয়ে যতটুকু পেরেছি ততটুকু করেছি। কিন্তু আমার যে সব প্রতিশ্রুতি ছিল তার অনেক কিছুই পূরণ করা বাকি আছে। ২০২১ আমাদের এলাকার উন্নয়নের জন্য সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সাহেবসহ আমরা ৯ মাস পরিশ্রম করে এক হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার যে উন্নয়ন বরাদ্দ পেয়েছি, তা নিয়ে ভালোভাবে কাজ করা।

জানতে চাইলে কুসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, এভাবে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া বা প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রচারণা চালানো নির্বাচন কমিশনের আইনবিরোধী। কোনোভাবেই নির্বাচনের আইন যদি কেউ ভাঙে তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসলে সেগুলোর বিষয়েও একইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুসিক নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বলেন, কোনো ধরণের অনৈতিক কাজ করার মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করার ভাবনা আমাদের নেই। আমরা আইন মেনেই সবকিছু করে জনগণের পাশে পৌঁছাতে চাই। জনগণের ভোটে আমাদের আস্থা আছে আর সেই আস্থা নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই।

তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কাছে যে কোনো অনিয়মের বিপক্ষেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদে আগ্রহীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৭ মে। ১৯ মে মনোনয়নপত্র বাছাই ও ২৬ মে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময়। ১৫ জুন এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইতোমধ্যেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এবার ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন মহিলা এবং ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন পুরুষ। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ২ জন। ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজও শেষ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র ছিলেন মনিরুল হক সাক্কু।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লা পৌরসভা ও সদর দক্ষিণ পৌরসভার ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আফজল খানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু।

এরপর ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ২০১৭ সালের ৩০ মার্চের নির্বাচন। বিএনপিসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কঠোর সমালোচনার মুখে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে কুসিক নির্বাচন করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছিল ওই নির্বাচন কমিশন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের নির্বাচন কমিশনের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সামনেও কুসিক নির্বাচনই প্রথম চ্যালেঞ্জ।

এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে কুসিক এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হচ্ছে। প্রথমে এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হচ্ছে। এর আগে ১২ মে থেকে ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়। নির্বাচনী এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও সব ধরনের শোডাউন বন্ধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে।

৯ মে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পুলিশ, বিজিবি ও আনসারকে পাঁচ নির্দেশনা দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নির্দেশনায় বলা হয়, ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা; নির্বাচনি এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের লক্ষ্যে অগ্রিম বাজেট প্রণয়ন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করণের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর সংশ্লিষ্টতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ গ্রহণ করতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close