বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ । মিছিলে মিছিলে সারাদেশ উত্তাল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই মূলত তার নির্দেশ অনুযায়ী চলতে থাকে দেশ। চরমে পৌছে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন।
ঠিক ঐ মুহূর্তে মওলানা ভাসানী ৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে পল্টনে এই ভাষণ দেন। সে জন্যই দুদিন পর পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী বললেন, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।’ তিনি এও বললেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেলে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।’ একইভাবে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। “লা-কুম দিনিকুম অলিয়া দ্বীন” অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
একাত্তরের এই দিনে ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে।
৯ মার্চ উত্তাল ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার চিরাচরিত দরাজ কণ্ঠে আরো ঘোষণা দেন, ‘হে বাঙালিরা, আপনারা মুজিবের উপর বিশ্বাস রাখেন, তাকে খামোকা কেউ অবিশ্বাস করবেন না, কারণ মুজিবকে আমি ভালোভাবে চিনি।’
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় মওলানা ভাসানী নিম্নোক্ত ১৪-দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেনঃ ১। বিগত ৯ জানুয়ারি (১৯৭১) সন্তোষ সম্মেলনে এবং ১০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় ঘোষিত স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন; ২। উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ ও সুষম বণ্টন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম এবং ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা; ৩। পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের বিকল্প সকল বিদেশী পণ্য বর্জন; ৪। পূর্ব বাংলার সর্বস্তরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন; ৫। শেখ মুজিবুর রহমান খাজনা, ট্যাকস বন্ধের যে আহ্বান জানিয়েছেন তা যাতে সুষ্ঠুভাবে পালিত হয় সেজ্জন্য সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে লবণ শুল্ক, নগর শুল্ক, হাট-বাজারের তোলা, খাজনা, ইনকাম ট্যাক্স, কৃষি ট্যাক্সসহ সমুদয় ট্যাক্স প্রদান সুসংগঠিত ভাবে বন্ধ রাখা; ৬। নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগণকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সামরিক সৈন্য, কর্মচারী ও সরকারী কর্মচারীদের নিকট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি বন্ধ রাখা; ৭। পূর্ব বাংলার বর্তমান খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে যাতে কোন দ্রব্য সামগ্রী সীমান্তের অপর পারে চোরাচালান না হতে পারে তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা; ৮। ত্রিশ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণের নিমিত্ত স্বেচ্ছায় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পতিত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা; ৯। পূর্ব বাংলায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যাংকসমূহে কোন টাকা জমা না রাখা; ১০। দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখার জন্যে কালোবাজারী ও আড়তদাররা যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মওজুত করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া; ১১। বাংগালী-অবাংগালী, হিন্দু-মুসলমানের দাংগা বাঁধিয়ে গণসংগ্রামকে বিপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করা; ১২। বাংগালী জাতির মুক্তির আন্দোলনের নামে টাউট ও প্রবঞ্চকরা যাতে চাঁদা তুলতে না পারে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা; ১৩। বিদেশী সৈন্য যাতে পূর্ব বাংলার মাটিতে অবতরণ করতে না পারে, তজ্জন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার সামুদ্রিক বন্দরগুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা; ১৪। গণবিরোধী শাসক চক্রের তমঘা, খেতাবসহ বিভিন্ন উপঢৌকন বর্জন করা। সূত্র : ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ- ৭২৩-২৪