আন্তর্জাতিকমতামতরাজনীতি

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায় এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে

‘আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া: মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকার ভূরাজনীতির ঝুঁকির ওপর প্রভাব’ শীর্ষক ১২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে ৬টি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিবেদনটিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে খুব শিগগির মার্কিন সেনা প্রত্যাহার না হওয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকায় মার্কিন নেতৃত্ব দুর্বল হওয়ার প্রেক্ষাপটে চীনের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়া, মার্কিন মিত্রদের স্বাধীনভাবে নিরাপত্তার নীতিগত অবস্থান চূড়ান্ত করা, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার ফলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কার মতো বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, আফগানিস্তানে তালেবান যে গতিতে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, তাতে অনেকে চমকে গেছে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে চিরাচরিত মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা যে ঝুঁকিপূর্ণ, এই ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি তালেবানের ক্ষমতা দখলের ফলে বৈশ্বিক অন্য শক্তিগুলোর এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগের সম্ভাবনার দিকটিও সামনে এসেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল, মিসরের মতো যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত মিত্রদের বৈশ্বিক অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই তাদের আঞ্চলিক তৎপরতার চেষ্টা চালাতে পারে। এতে সামগ্রিকভাবে সম্পর্কে নতুন মেরুকরণ যেমন হতে পারে, তেমনি নতুন করে অস্থিতিশীলতাও সৃষ্টি হতে পারে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ধীরে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির গুটিয়ে যাওয়ার এক নির্মম সাক্ষ্য মিলছে। এতে করে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট খালি জায়গা পূরণের জন্য অন্য বড় শক্তিগুলোর সামনে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সমরাস্ত্রের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে রাশিয়া এর সুফল পেতে পারে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা সমরাস্ত্র কেনাকাটায় বৈচিত্র্য আনতে চাইলে রাশিয়া এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ব্যাপক সুফলের ভাগটা চীনের দিকেই যাবে। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী পুনর্গঠন, অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীন এগিয়ে থাকবে। পাশাপাশি অর্থায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে চীনের ভূমিকা হবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল ও মিসরের মতো মার্কিন মিত্ররা এখন আর আগের মতো ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারবে না। এসব দেশকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে তাদের জন্য নিজেদের মতো করে চলমান সংঘাত নিরসনে আরও আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে।

তবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনটি পরস্পরবিরোধী ধারা এ সময় চলমান থাকবে। ধারাগুলো হলো—মার্কিনঘেঁষা জোট, যারা বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার পক্ষে; ইরানপন্থী পক্ষ ও ইসলামপন্থীদের সমর্থনকারী পক্ষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পর এ অঞ্চলে প্রভাবক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের জন্য যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাতে আঙ্কারা পিছিয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করোনা মহামারিতে অর্থনীতি পর্যুদস্ত হওয়ায় দেশটির পক্ষে ভবিষ্যতে সামরিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের দূরত্ব বেড়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় নিজের প্রভাব বাড়ানোর পরিবর্তে তুরস্কের লক্ষ্য থাকবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল ও মিসরের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমন।

এ অঞ্চলে প্রভাববলয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে তুরস্কের তুলনায় রাশিয়ার অবস্থা বেশ ভালো। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারের পাশাপাশি ইরানকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুরস্ক, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে দেশটি বিরোধে জড়িয়ে পড়েনি। অর্থাৎ, ভূরাজনৈতিক বিরোধিতা থাকার পরও মস্কো যে বাস্তবসম্মতভাবে সংকট মোকাবিলায় আগ্রহী, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে, সে তুলনায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়াটা ছিল অনেকখানি গোছানো।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বাশার আল–আসাদের সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয় রাশিয়া। সেখানে থেকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়া নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের কূটনীতিতে রাশিয়ার বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close