আইন ও অধিকারজাতীয়বিনোদন

সিরিয়াল কিলার হেলাল যেভাবে বাউল সেলিম হয়ে ওঠেন

দীর্ঘ ২০ বছর নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন আলোচিত ‘ভাঙা তরি ছেঁড়া পাল’ গানের বাউল মডেল সেলিম ফকির। তার আসল নাম হেলাল হোসেন (৪৫)। বাড়ি  বগুড়ায়। র‌্যাব বলছে, তিনি একজন সিরিয়াল কিলার। একাধিক হত্যা মামলার আসামি। পরিচয় গোপন করতে বেশভূষা পরিবর্তন করে তিনি বড় চুল ও দাঁড়ি রাখেন। পলাতক থেকে তিনি বাউল গান ও গানের মডেলিং করতেন।

গতকাল বুধবার রাতে তাকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

২০০১ সালে বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নিহতের পরিবারের একজন সদস্য বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। ২০০৬ সালে রবিউল নামে এক ব্যক্তিকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। সেই মামলায়ও হেলাল চার্জশিটভুক্ত আসামি।

এ ছাড়া ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এ ছাড়া ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেফতার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। তাছাড়া নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে নিজ এলাকায় ‘দুর্ধর্ষ হেলাল’, ‘খুনি হেলাল’ নামে পরিচিতি পান তিনি।

২০১০ সালে চুরির মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। এরপর ২০১৫ সালে জামিন পান। ওইদিনই বিদ্যুৎ হত্যা মামলার রায় হয়। রায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। আদালতে হাজির না হয়ে তিনি সুকৌশলে এলাকা ছাড়েন। এরপর শুরু হেলালের ফেরারি জীবন।

র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে হেলাল জানিয়েছেন, প্রথমে তিনি বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যান। সেখানে আমানত শাহের মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে ট্রেনে সিলেটের হজরত শাহজালাল মাজারে চলে যান। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে গিয়ে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন করেন হেলাল। নিজেকে সেলিম ফকির নামে পরিচয় দেন। সেখান থেকে তিনি সেলিম ফকির নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালের দিকে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশের একটি গানের শুটিং চলাকালে রেললাইনের পাশে বাউল গান গাচ্ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। এরপর বহুল জনপ্রিয় ‘ভাঙা তরি ছেঁড়া পাল’ গানে মডেলিং হন হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির।

যাবজ্জীবন দণ্ডের পর পলাতক হেলাল প্রায় সাত বছর ফেরারি জীবনযাপন করেছেন। সর্বশেষ চার বছর তিনি কাটিয়ছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে স্টেশনের পাশেই এক নারীকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। স্টেশনে বাউল গান শুনিয়ে মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থেই চলতো তার সংসার।

বাউলের বেশ ধারণের পর ‘সেলিম ফকির’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। পথে পথে ঘোরার পর থিতু হন রেলওয়ে স্টেশনে। গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন হেলাল ওরফে সেলিম ফকির। গানের গলা ভালো হওয়ায় নজরে পড়েন এক ইউটিউবারের। তার হাত ধরেই শুরু করেন বাউল গানের মডেলিং।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন হেলাল হোসেন। একসময় মুদিখানার দোকান চালাতেন তিনি। পরে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শুরু করেন। কেউ যাতে তার চেহারা চিনতে না পারেন, সেজন্য লম্বা দাঁড়ি ও চুল রাখেন। একটি বাউল গানের শুটিংয়ের সময় তাকে মডেল হিসেবে অভিনয় করানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়,  হেলালের কপাল পুড়ে ‘ভাঙা তরি ছেঁড়া পাল’ গানে বাউল মডেল হিসেবে অভিনয়ের পর। প্রায় ৫ বছর আগে মডেলিং করা তার এই গানটি বছরখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার গান সম্প্রতি ভাইরাল হওয়াই কাল হয় হেলালের। পরিচিতজনরা তাকে চিনে ফেলেন। তার পরিচয় নিশ্চিত হন স্থানীয়রা। এরপর হেলালের বেশভূষা বদলের তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করেন র‍্যাবে।

স্থানীয়দের তথ্য ধরে ৬ মাস চেষ্টার পর র‍্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন। বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে হেলাল হোসেন ওরফে খুনি হেলাল ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ৬ মাস আগে এক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র‍্যাবের কাছে তথ্য দেন। তখন জানানো হয়, এই বাউল মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ পেয়ে র‍্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র‍্যাব।

হেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা আছে। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় তার সাজাও দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও দুটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা আছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close