জাতীয়ঢাকানারায়ণগঞ্জ
ঢাকা,নারায়ণগঞ্জে বেড়েছে লোডশেডিং, জনমনে অসন্তোষ
কথা ছিল দিন-রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। সেটাও আবার হবে এলাকাভিত্তিক শিডিউল করে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নজির চোখে পড়েনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত আট ঘণ্টাই বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তারা বলছেন, যখন-তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পরেও বিদ্যুৎ আসে। একদিকে লোডশেডিং অন্যদিকে ভ্যাপসা গরমে এক রকম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। গত কয়েক বছরে এ খাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে। এই সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং প্রায় বিদায় নিয়েছিল। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো না বললেই চলে। কিন্তু সেই জ্বলজ্বলে শহরে এখন হঠাৎ করে প্রায়ই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গত কয়েক মাসে গ্রামের মতো শহরেও বাড়ছে লোডশেডিং। আর তা এখন খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। দিন-রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও এখন তা পাঁচ, ছয় কখনো আট ঘণ্টায় ঠেকেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি গ্রিড বিপর্যয়ের পর লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে। সংকট দ্রুতই কেটে যাবে বলে যদিও আশ্বস্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তি থাকায় চাপের মুখে পড়ে সরকার। তাই তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন কমিয়ে এনে লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই শিডিউলে গ্রামাঞ্চল বা শিল্পাঞ্চল নেই, সে সব এলাকায় কম গুরুত্ব দিয়ে শিল্পাঞ্চল আছে এমন এলাকার পাশাপাশি সরবরাহ স্থিতিশিল রাখা হয় রাজধানীতে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, গত ৭-৮ বছরে শহরের মানুষ বিদ্যুৎ নিয়ে অন্তত এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন থেকে চারদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের সময় বেড়ে গেছে।
এদিকে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে লেখালেখি চলছে। বাড়ছে জনঅসন্তোষ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গতকাল শনিবার (৮ অক্টোবর) বিদ্যুতের চাহিদা পিকআওয়ারে ছিল ১৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, আর উৎপাদন করা হয়েছে ১১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতি দেখা গেছে। এর আগের দিন শুক্রবার পিকআওয়ারে চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াট আর উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট, সে হিসাবে ২ হাজার ৬৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, দিনে গড়ে দুই হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাই লোডশেডিং এর পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘যখন জ্বালানি সংকট সামনে আসে তখন পরিকল্পনা করা হয় বিদ্যুতের যেটুকু ঘাটতি দেখা দেবে তা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে সাধারণ অনেক মানুষই সরকারকে সহযোগীতা করছে না। এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিলে অনেকেই আইপিএস, জেনারেটরে পাওয়ার রিজার্ভ করছে। এতে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সরবরাহ কমেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘উৎপাদন তো কম হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং কখনো কখনো বাড়াতেও হচ্ছে। তবে যতটা সম্ভব একেকবারে কম দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এদিকে গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টার কিছু সময় পর জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে ঢাকাসহ দেশের চার বিভাগের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, পিএম কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির ভবনও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।
এই বিপর্যয়ের কারণে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শূন্যে নেমে এসেছিল। ওই সময়ে এক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা কাটিয়ে উঠতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লেগে যায়। ওই ঘটনা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটিও কাজ করছে।
গত বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, নাশকতার উদ্দেশে বিষয়টি ঘটেছে কি না বা যান্ত্রিক ত্রুটি কি না- এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই বিপর্যয়ের পর থেকে সিলেট বিভাগে লোডশেডিং বাড়ছে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে। একই কারণে রাজধানী ঢাকাতেও লোডশেডিং বাড়ছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছে।
সরকারের হিসাবে ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি, যা এখন ১৫২টিতে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট (১৬ এপ্রিল ২০২২)। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লাখ। মোট সঞ্চালন লাইন (সা.কি. মি) ১৩ হাজার ৮৮৯। গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ৫৬ হাজার ৬২৮, বিতরণ লাইন ( কি.মি) ৬ লাখ ২৯ হাজার। সিস্টেম লস ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ (জুন ২০২২)। মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদন (কি: ও: আ:) ৬০৮ দশমিক ৭৬, বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ১০০ ভাগ, প্রি-পেইড মিটার স্থাপন ৫১ লাখ ৭ হাজার ৪৫২টি এবং সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ।