জাতীয়জেলা/উপজেলাঢাকা বিভাগনারায়ণগঞ্জনারায়ণগঞ্জ সদরনির্বাচনী হালচালবিভাগরাজনীতিসারাদেশ

মনির কাসেমীকে পরাজিত করে এমপি হতে ইসলামী দলগুলোতে প্রতিযোগিতা

বজ্রধ্বনি ডেক্স:
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন। নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সারাদেশে আলোচিত আসন৷ এই আসনে বিগতদিনে এমপি একেএম শামীম উসমান। মনে করা হয়, এই আসনের মানুষ বিগতদিন সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে ও ভীতিকর অবস্থার মধ্যে সময় অতিবাহিত করেছে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে গডফাদারখ্যাত শামীম উসমান সপরিবারে পালিয়ে গেলে এই এলাকার মানুষ নতুনভাবে বেঁচে থাকার আশা পায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার দরজায় কড়া নাড়ছে। সারাদেশের মতো এই এলাকায়ও বিভিন্ন দল প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে নির্বাচনের সময় কে চূড়ান্ত হিসেবে প্রার্থী হবে এবং জনগণ কাকে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিবে এর কোনো চূড়ান্ত অনুমান এখনো কেউ করতে পারছে না। একেকদিন একেক গুঞ্জন। নির্বাচনের সময় যতো নিকটে আসছে জনগণের হিসেবনিকেশ ততই যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে।

এবার জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামিলীগ সরাসরি না থাকলেও বিএনপির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতো আলাদা ফোরাম ইতিমধ্যেই জামায়াত-মজলিস-চরমোনাই সমন্বিতভাবে তৈরি করে ফেলেছে। কয়েকদিন আগে বিএনপি দেশব্যাপী ২৩৭ টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা দেয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এই আসনটি তাদের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে ছেড়ে দিয়েছিলো। নির্বাচনের আগমুহূর্তে হঠাৎ করে জোট থেকে নমিনেশন বাগিয়ে নিয়ে প্রার্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন জমিয়ত নেতা মুফতি মনির কাসেমী। কিন্তু প্রার্থী হলেও তখন কোনোরকম প্রচারণায় নামেননি মনির কাসেমী। কথিত আছে মনির কাসেমীর সেক্রেটারি ফেরদৌসুর রহমান নারায়ণগঞ্জে সাবেক এমপি শামীম উসমানের ছোটভাই হিসেবে পরিচিত। ফেরদৌসের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনির কাসেমীকে ম্যানেজ করে নেয় শামীম উসমান। তখন মনির কাসেমী হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বলে ভর্তি হলে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের এসপি হারুন সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ করে ছবি তুলে এবং কিছুদিন আগে তা ভাইরাল হয়।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বেশিরভাগ ইসলামী দল একবাক্স নীতিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকলেও জামায়াতের সাথে ঐক্য না করার কথা বলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির সাথেই থেকে যেতে চায়। জামায়াত-মজলিস-চরমোনাই সহ শক্তিশালী ইসলামী দলগুলো বিপরীত দিকে অবস্থান নেওয়ায় বিএনপিরও ইসলামী দল হিসেবে জমিয়তকে খুবই দরকার। ধারণা করা হচ্ছে, এবারও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি জোটের স্বার্থে জমিয়তকেই ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে, দীর্ঘদিন যাবত এখানে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় দলের তৃণমূল পর্যায়ে চরম হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে। এবার ধানের শীষের প্রার্থী কেন্দ্র থেকে ঘোষণা না দিলে স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপির একাধিক হেভিওয়েট নেতা৷ এদিকে নির্বাচন কমিশনের করা নিয়মে, এবার জোটের প্রার্থী হলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে মনির কাসেমী আসনটি পেলে জমিয়তের মাঠপর্যায়ে কাজ না থাকায়, কর্মী সংকট, তার একান্ত সহকর্মী ফেরদৌসুর রহমান সহ প্রায় সবার সাবেক এমপি শামীম উসমানের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও হেফাজতের কমিটি গঠন নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাওলানা আব্দুল আউয়াল সহ শীর্ষস্থানীয় সকল আলেমদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন কারণে মনির কাসেমী ইমেজ সংকটে ও বিতর্কিত অবস্থানে চলে গেছেন। এজন্য বিএনপির একাধিক নেতা স্বতন্ত্র হিসেবেই জয়ী হয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া এখনো পর্যন্ত ধানের শীষের প্রার্থী হতে বিএনপি নেতা শাহআলম, ভিপি রাজীব, মশিউর রহমান রনি সহ কয়েকজন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অপরদিকে বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য ও জমিয়ত ইসলামী দলগুলোর ঐক্যে না থাকার কারণে মনির কাসেমীর আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রতিযোগিতা করছে ইসলামী অন্যান্য সকল দল। এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হয়েছেন, দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও মহানগর সভাপতি এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুল জব্বার। প্রার্থীতা ঘোষণার পর থেকেই তিনি দিনরাত একাকার করে পাড়া মহল্লায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি নেতারা এবং মনির কাসেমীও জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন। নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনটি খেলাফত মজলিসের প্রার্থী সিরাজুল মামুনের জন্য কেন্দ্রীয় সমঝোতার সময় ছেড়ে দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকায় জামায়াত নারায়ণগঞ্জের আসনগুলোর মধ্যে এই আসনটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয়ভাবে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তাদের সহযোগী সংগঠন উলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের যুগ্মসম্পাদক মুফতি ইসমাঈল সিরাজীকে। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে তাকে কোনো ভূমিকায় না দেখা গেলেও ইসলামী আন্দোলন দল হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শামীম উসমানের হুমকিতে আগেরদিন নির্বাচন থেকে দুইজন প্রার্থী সরে আসে। তবু নির্বাচনের দিন ভোটে চমক দেখিয়েছে এই দলটি। এই দলটিরও বিশেষ টার্গেট নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন৷ দলীয় অবস্থান শক্তিশালী থাকায় নারায়ণগঞ্জের আসনগুলোর মধ্যে এই আসনটি প্রথম টার্গেট তাদের। যেকোনো মূল্যে এখানে তারা প্রার্থীতা টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এজন্য, ইদানীং তাদের প্রার্থী ইসমাঈল সিরাজী মটর সাইকেল শোডাউন সহ বিভিন্ন এলাকায় খন্ড খন্ড প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে, সিরাজীর প্রার্থীতার ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন নেতাকর্মীকে নেগেটিভ মন্তব্য করতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেছেন, সিরাজীর ব্যাপারে লেনদেন সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ আছে। আমরা কেন্দ্রে বিষয়গুলো জানিয়েছি৷ আশা করি কেন্দ্র প্রার্থীতার ক্ষেত্রে এই আসনটিতে পুনর্বিবেচনা করবে। তবে, প্রার্থী যেই হোক আসনটি ছাড়তে নারাজ দলটি।

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্র থেকে দেওয়াল ঘড়ি মার্কার প্রার্থী হিসেবে মহানগর সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আহমদকে ঘোষণা করা হয়েছে। আসন জুড়ে ফেস্টুন, লিফলেট সহ ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মজলিস নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা হলেও মূলত ৫ ও ৪ এই দুটি আসনই কেন্দ্রীয় সমঝোতায় গুরুত্বের সাথে চাওয়া হবে৷ দুটো আসনই জোট থেকে পেতে এবং একসাথে নির্বাচন করতে চায় দলটি৷ এজন্য প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় নেতাকর্মীদের নিয়ে ছুটে চলছেন প্রার্থী নিজেই।

মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস শেষ সময়ে এসে খন্দকার আনোয়ার হোসেনকে দলে ভিড়িয়ে আগের ঘোষিত প্রার্থীকে পরিবর্তন করে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। এ উপলক্ষে মামুনুল হক নিজে নারায়ণগঞ্জে এসে এই ঘোষণা দিয়ে গেছে। ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ফেস্টুন, পোস্টার এবং দু’একটা এলাকায় গণসংযোগ করতে দেখা গেছে প্রার্থীকে। খন্দকার আনোয়ার একজন ব্যবসায়ী ও তাবলীগের লোক। দলীয় নেতাকর্মী তেমন একটা না থাকলেও তাবলীগের বিভিন্ন লোকদের সাথে নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের ব্যাপারে ইসলামী দলগুলোর সমঝোতায় এই আসনটি পাওয়ার ব্যাপারে দলনেতা মামুনুল হকের গ্রীণ সীগন্যাল পেয়েই তিনি মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। এই আসনে ইসলামী দলগুলোর অবস্থান ভালো থাকায় এটি সমঝোতায় পেলে তিনি মনির কাসেমীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন বলে বেশ আশাবাদী।

নারায়ণগঞ্জের আর কোনো আসনে প্রার্থীতা নিয়ে এত জটিলতা না থাকলেও এই আানটি বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে পাবে তা নিয়ে ইসলামী দলগুলোতে বেশ কৌতুহল কাজ করছে৷ তবে ইসলামী দলের যিনিই এ আসনটি বাগাতে পারবে, তার জন্যই ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এই আসনটিতে৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close