নারায়ণগঞ্জরাজনীতি
“এশিয়া বুক অব রেকর্ড” এর স্বীকৃতি পেল টিম খোরশেদ
করোনা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দাফন-সৎকার, অক্সিজেন, প্লাজমা,এম্বুলেন্স ও টেলিমেডিসিন সার্পোট এবং খাদ্য, কর্ম ও শিক্ষা সহায়তা প্রদান করায় “এশিয়া বুক অব রেকর্ড” এর স্বীকৃতি লাভ করেছে “টিম খোরশেদ”।
ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত “এশিয়া বুক অব রেকর্ড” এর প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো সনদপত্র, মেডেল ও স্যুভেনির গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে টিম খোরশেদ এর কাছে পৌছেছে।
টিম খোরশেদ এর টিম লিডার কাউন্সিলার মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ এই অর্জনকে সকল টিম মেম্বারদের প্রতি উৎসর্গ করে বলেছেন, এই স্বীকৃতি আমাদের সকল স্বেচ্ছাসেবকদের ত্যাগের ফসল ও আল্লাহর রহমত। আমরা আমাদের ওয়াদা মোতাবেক করোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিম খোরশেদ সক্রিয় থাকবে ইনশাআল্লাহ।
টিম খোরশেদের কার্যক্রম সম্পর্কে টিম লিডার খোরশেদ জানান, করোনা নামক মরনঘাতী মহামারী দামামা বাজিয়ে সারা বিশ^কে টালমাতাল করে ৮ র্মাচ ২০২০ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত সনাক্ত হলো নারায়নগঞ্জে। সারা শহরের পাশাপাশি দেশব্যাপি এক অজানা মৃত্যু ভয় শংকিত কওে তুললো সবাইকে।
মৃত্যু ভয়ের মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবো।আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের উপর ভরসা করে ৯ র্মাচ ২০২০ কাজ শুরু করি। প্রথমেই আমরা করোনা থেকে বাচাঁর জন্য মানুষকে সচেতন করার জন্য লিফলেট ছাপিয়ে পাড়া মহল্লায়, মার্কেট, বাজার, মসজিদ, মন্দিরে বিলি করা শুরু করি। সাথে দেয়া শুরু করি সার্জিক্যাল মাস্ক।
এভাবেই আমাদের শুরু, সপ্তাহ খানেক পরে ১৮ মার্চ সরকারি ভাবে ঘোষিত হয় করোনায় একজনের মৃত্যু সংবাদ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যু ভয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মার্কেট,ফার্মেসী গুলো শূন্য হয়ে গেল, কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না স্যানিটাইজার সহ সুরক্ষা সামগ্রী।
এই অবস্থায় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ও বিদ্যানন্দ থেকে ফর্মুলা নিয়ে স্যানিটাইজার বানানো শুরু করি। ১৮ মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত আমরা ৬০ হাজার বোতল স্যানিটাইজার ও কাপড় কাচাঁর সাবান প্রক্রিয়াজাত করে ১০ হাজার বোতল লিকুইড সাবান তৈরী করে পাড়া মহল্লা পেরিয়ে সাড়া জেলায় বিনামূল্যে বিতরণ শুরু করি।
এই সময়ে আমাদের নিয়ে সাধারন মানুষ ও মিডিয়ার আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমাদের একটি টিম ওয়ার্কের নামকরনের প্রয়োজন হয়ে পরে। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় আজকের ”টিম খোরশেদ” এর।
মার্চ ২০২০ এর শেষ দিকে করোনায় যখন মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন আমরা দেখি করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ গুলো দাফন বা সৎকার করা নিয়ে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তান তার মৃত মাকে জংগলে ফেলে যাচ্ছে।কবর খননের লোক পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি কবরস্থানে দাফন করতে গেলে এলাকাবাসি বাধা দিচ্ছে।
এই অবস্থায় আমরা টিম খোরশেদ এর পক্ষ থেকে নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনকে চিঠি দিয়ে করোনা মৃতদেহ দাফন ও সৎকারের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করি।এবং ০৪ এপ্রিল থেকে আমরা করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মৃতদের দাফন ও সৎকার শুরু করি, যা ছিল সারাদেশের মধ্যে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগ।
এর আগে আমরা আমাদের সহযোগী সংগঠন টাইম টু গীভের সহায়তায় লন্ডন রয়েল হসপিটালের করোনা ইউনিটে কর্মরত ডা.তানভীরের কাছে অনলাইনে প্রশিক্ষন নেই কিভাবে করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ হ্যান্ডেল করতে হয়।
এরপরে আমরা স্থানীয় ভাবে কিছু পিপিই বানিয়ে, বাজার থেকে গামবুট ও গ্লাভস কিনে কাজে নেমে পরি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেন।
একের পর এক দাফন/সৎকার করা শুরু হলে আত্বীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধব অনেকেই আমাদের সাবধান করেন,কেউ কেউ সরাসরি বাধাও দেন। কিন্তু আমরা আমাদের টিমের শ্লোগান ”করোনা আক্রান্ত মৃতদেহের স্বজন আমরা” সামনে রেখে সকল বাধা ও সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে দাফন ও সৎকার চালু রাখি।
আমাদের দাফন ও সৎকারের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পরলে আমরা যেমন বাহবা পেতে শুরু করি, তেমনি মানুষের মধ্যে যে অজানা মৃত্যুূ ভয় কাজ করছিলো তা আমাদের কাজ দেখে ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। বিভিন্ন জেলা থেকে তরুণ যুবকরা আমাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে, তারাও তাদের জেলায় দাফন সৎকারের দায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নেয়।
আমরা অনলাইনে তাদের মৃতদেহ গোসল ও দাফনের পদ্ধতি শিখাই,তাদের সুরক্ষা সামগ্রী দেই।সর্বোপরি আমরা কতজন দাফন করলাম তার সংখ্যার কৃতিত্ব নেয়ার চেয়ে আমরা গর্বিত এই কারনে যে,আমরা মানুষের ভয় ভাংতে সক্ষম হয়েছি। আমরা মানুষকে সাহসী করতে পেরেছি। এটাই আমাদের মূল সার্থকতা।
ইতিমধ্যে আমরা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ১০ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে টেলিমেডিসিন সেবা শুরু করি। জুন ২০২০ এর শুরু থেকে টিম খোরশেদ এর কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হয়।আমাদের টিমে যুক্ত হয় ফ্রী অক্সিজেন,ফ্রী এম্বুলেন্স ও ফ্রী প্লাজমা ডোনেশন প্রক্রিয়া।
অদ্যবদি আমরা ৬৩০ জন মানুষকে ফ্রী অক্সিজেন সাপোর্ট, ১০৬ জনকে ফ্রী এম্বুলেন্স সাপোর্ট ও ১১২ জনকে প্লাজমা ডোনেসন, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সারা দেশের প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম হয়েছি এবং ২৮৫ জনের দাফন ও সৎকার সম্পূর্ন করার পাশাপাশি ০৯ হাজার পরিবারকে কয়েক দফা খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি।যা অংকের হিসাবে প্রায় ১৭০ টনের উপরে।
আমরা লকডাউন চলাকালে দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য পক্ষকাল ব্যাপী প্রতিদিন এক হাজার পরিবারকে বিনামূল্যে তিন কেজি করে সবজী ও পরিবার প্রতি ৬টি করে ৪০ হাজার ডিম বিতরণ করেছি।আমরা করেনায় কাজ হারানো মানুষকে সেলাই মেশিন,ক্ষিার্থীদের শিক্ষা সহায়তা রপ্রদান করি।এবং মধ্যবিত্ত্বের জন্য ৩০% ডিসকাউন্টে পন্য সরবরাহ করি।আমাদের সকল সেবা বিনামূল্যে প্রদত্ত।
আমরা এসকল কার্যক্রম চালাতে এড়িয়ে গিয়েছি জাতি ধর্ম ও দলমতের বেড়াজালকে।আমাদের সামনে একটাই টার্গেট ছিলো,যে কোন উপায়ে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে হবে।আমরা শুরুর দিকে রোজা রেখেই অনেক হিন্দু ধর্মাবল্বীর মুখাগ্নী পর্যন্ত করেছি।
ভয়ে কোন আত্মীয় স্বজন আসেনি মৃতদেহের সাথে।তাই বাধ্য হয়ে আমরাই মৃতের স্বজন হয়ে মুখাগ্নি করেছি।অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করে এনেছি বাড়ির সিড়ি ও উঠান থেকে।এমন অনেক মৃতদেহ আমরা দাফন করেছি, যাদের জানাযায় পরিবারের কেউ অংশ নিতে আসেনি করোনা আক্রান্তের ভয়ে।এমন মৃতদেহের কবর গুলো আমরা চিন্থিত করে রেখেছি। যাতে পরবর্তী সময়ে তার পরিবারের কেউ এলে আমরা তাদের স্বজনের কবর চিনিয়ে দিতে পারি।
বিশ^জুড়ে করোনার মত ভয়াবহ মহামারী শতাব্দীতে একবার আসে। আমাদের জীবনকালে আর ্এধরনের বিপর্যয় আসবে না। তাই আমরা মনে করেছি মানব জন্ম সার্থক করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়, দূর্গত মানুষের পাশে দাড়ানোর উপযুক্ত সময়। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভয় পেয়ে পালিয়ে থাকলে চলবে না।
আমরাও তো কোন না কোন ভাবে আক্রান্ত হতে পারি।আমাদের মৃতদেহও তো বাড়িতে পরে থাকতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধুমাত্র শবযাত্রীর অভাবে। তাই মনের তাগিত থেকেই আমরা করোনা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছি।
আমরা কোনকিছু প্রাপ্তির আশায় জীবন বাজি রাখিনি।আমরা কোন মৃত ব্যাক্তির বাড়ি বা হাসপাতালে পৌছালে তার স¦জনের চোখে যে নির্ভরতার ছায়া দেখি সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।মানুষ আমাদের প্রতি যে বিস্বাস ও আস্থা রেখেছে সেটাই আমাদের আত্বতৃপ্তি। শুরু থেকে আজ প্রায় দেড় বছর হতে চললো একদিনের জন্যও আমরা পিছ পা হইনি।আমরা আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখবো করোনার শেষদিন পর্যন্ত।
আমি টিম লিডার হিসাবে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার সকল টিম মেম্বারদের প্রতি।গত দেড় বছরে আমি ও আমার স্ত্রী সহ ১০ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েও আবারো কাজে ফিরেছি আল্লাহর রহমতে।আমি কৃতজ্ঞতা জানাই টাইম টু গিভ ও দিগন্ত ইনাটারন্যাশনাল এর প্রতি তাদের সার্বিক দিক নির্দেশনার জন্য।
কৃতজ্ঞতা জানাই মডেল গ্রুপের প্রতি, তারা আমাদের জন্য একটি সর্বাধুনিক এম্বুলেন্স দিয়েছেন। আমরা কখনো নগদ টাকা অনুদান হিসাবে গ্রহন করি না।তাই ইতিমধ্যে যারা আমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার,খাদ্য সামগ্রী,সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের প্রতিও আমরা চির কৃতজ্ঞ।
আল্লাহর রহমত ও সকলের সম্মিলিত সহায়তায় আমরা বাংলাদেশকে করোনা মুক্ত করতে ভুমিকা রাখবো এটাই আমাদের প্রত্যাশা।