জাতীয়নারায়ণগঞ্জনারায়ণগঞ্জ সদর
নারায়ণগঞ্জের তল্লা মসজিদে বিস্ফোরণের দুই বছর
বাঁচার আকুতি নিয়ে মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সড়কে জমে থাকা নর্দমার পানিতে। ঝলসানো শরীর নিয়ে হাসপাতালের বেডে বাঁচার আকুতি স্মরণ করে এখনো কেঁদে ওঠে স্বজনহারা মানুষেরা। দেখতে দেখতে ২ বছর গড়িয়ে গেলেও এখনো অনেকের কাছেই মনে হয় যেন সেদিনই ঘটলো ঘটনাটি। এখনে সেদিনের সেই ঘটনা স্মরণ করে আতঁকে ওঠেন এলাকাবাসী। চোখের সামনে জলজ্যান্ত মানুষগুলোতে এভাবে পুড়ে যেতে এর আগে দেখেনি কেউ। স্বজনহারাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। একের পর এক মৃত্যুর খবর যখন আসছিল তখনই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল স্বজনরা। শোকে বিহবল ছিল এলাকাবাসীও।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার তল্লায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনার ২ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ রোববার। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে সৃষ্টি হয়েছিল বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।জানা গেছে, ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর এই ঘটনায় দগ্ধ অবস্থায় ৩৭ জনকে জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে একে একে ৩৪ জন মারা গেছেন।
যে ৩৪ জন নিহত হয়েছিল : নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও তার ছেলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন (১৬), মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী আবদুল হান্নান (৫০), ইমরান (৩০), আবুল বাশার (৫১), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), জেলা প্রশাসনের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী শামীম হাসান (৪৫), স্থানীয় ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ নাদিম (৪৫), তল্লার বাসিন্দা নূর উদ্দিনের বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাব্বির (২১) ও মেজো ছেলে তোলারাম ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র জোবায়ের (১৮), জুলহাস উদ্দিন (৩০), মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাটবুকদিয়া গ্রামের কুদ্দুস বেপারী (৭২), চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পোশাক শ্রমিক জুলহাস ফরাজীর ছেলে জুবায়ের ফরাজী (৭), পটুয়াখালীর গলাচিপার আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. রাশেদ (৩০), পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৭২), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী গ্রামের জামাল আবেদিন (৪০), পোশাক শ্রমিক ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন (১২), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. জয়নাল (৩৮), লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুকপলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. নয়ন (২৭), ফতুল্লার ওয়ার্কশপের শ্রমিক কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), শ্রমিক মো. রাসেল (৩৪), বাহার উদ্দিন (৫৫), নিজাম ওরফে মিজান (৪০), আবদুস সাত্তার (৪০), শেখ ফরিদ (২১), নজরুল ইসলাম (৫০), ফতুল্লার নিউখানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে রিফাত (১৮)।
৫টি তদন্ত কমিটি : ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, সিটি করপোরেশন পৃথক পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেন।
সিআইডির তদন্তে দোষী তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটির গাফিলতি : মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। অভিযুক্ত তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সিআইডির তদন্তে অভিযুক্তরা হলেন- মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়া (৬০), মো. সামসুদ্দিন সরদার (৬০), মো. শামসু সরদার (৫৭), মো. শওকত আলী (৫০), মো. অসিম উদ্দিন (৫০), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪০), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (৪৫), মো. নাঈম সরদার (২৭), মো. তানভীর আহমেদ (৪৫), মো. আল আমিন (৩৫), মো. আলমগীর সিকদার (৩৫), মাওলানা মো. আল আমিন (৪৫), মো. সিরাজ হাওলাদার (৫৫), মো. নেওয়াজ মিয়া (৫৫), মো. নাজির হোসেন (৫৬), মো. আবুল কাশেম (৪৫), আব্দুল মালেক (৫৫), মো. মনিরুল (৫৫), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), মো. আসলাম আলী (৪২), আলী তাজম মিল্কী (৫৫), মো. কাইয়ুম (৩৮), মো. মামুন মিয়া (৩৮), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. বশির আহমেদ হৃদয় (২৮), মো. রিমেল (৩২), মো. আরিফুর রহমান (৩০), মো. মোবারক হোসেন (৪০) ও রায়হানুল ইসলাম (৩৬)। সিআইডি’র তদন্তে অগ্নিকান্ডের মূল কারণ উদ্ঘাটন করা হয়। মসজিদ কমিটির সঠিকভাবে মসজিদ পরিচালনায় অবহেলা, অ-ব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষনাবেক্ষন না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাৎক্ষনিক কোন ব্যবস্থা না নেয়া ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোঃ লিঃ (ডিপিডিসি) এর মিটার রিডিং কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে মসজিদের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোঃ লিঃ এর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ঘটনাস্থল এলাকার তিতাস গ্যাসের দায়িত্বে থেকে দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাস লাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন বা স্থানান্তর করার কারণে ভয়াবহ এই
অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়ে ৩৪ জন মুসল্লী অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ও ৪ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে সিআইডি’র তদন্তে সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটিা তদন্তে গ্যাস লাইনে লিকেজ, বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট, মসজিদ কমিটির অবহেলা ও রাজউকের অব্যবস্থাপনাকে বিস্ফোরণের ম‚ল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের হাতে এই প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি।এদিকে তল্লার মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের সাময়িক বহিস্কৃত ৮ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর গাফিলতি থাকায় স্বাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদেরকে রিমান্ডেও নেয় তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।তারা হলেন, তিতাসের ফতুল্লা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম, উপ ব্যবস্থাপক মাহামুদুর রহমান রাব্বী, সহকারী প্রকৌশলী এসএম হাসান শাহরিয়ার, সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া, সিনিয়র সুপারভাইজার মো. মুনিবুর রহমান চৌধুরী, সিনিয়র উন্নয়নকারী মো. আইউব আলী, হেল্পার মো. হানিফ মিয়া ও কর্মচারী মো. ইসমাইল প্রধান। পরে আদালত তাদেরকে জামিন প্রদান করে। বেশ কিছুদিন পরে সাময়িক বহিস্কৃতদের স্বপদে বহাল করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে মামলায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুরসহ বিদ্যুতের মিস্ত্রিকেও গ্রেফতার করে সিআইডি। পরে মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুরসহ আসামীরা সকলেই আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দীর্ঘ এক বছর ধরে বন্ধ থাকা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদ গেল বছরের ২৯ আগষ্ট ৬টি শর্তে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল।