নারায়ণগঞ্জ

চাষাড়া রেল স্টেশনে স্বজনরা ফেলে গেলেও তরুণরা পারেনি, রক্ষা পেল বৃদ্ধ

আকাশে মেঘ জমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে গন গন। যেকোন সময় আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি নামবে। রাতের দ্বিতীয় প্রহর চলছে। সবাই যে যার গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাস, ট্রেন স্টেশনে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকাগামী শেষ ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। মুহুর্তেই স্টেশন জনমানব শূন্য হয়ে পড়লো৷ সে সময় স্টেশনে আড্ডারত কয়েকজন তরুণ হঠাৎ গোঙানির শব্দ পেলো। পিছু ছুটলো সেই শব্দের। এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পাশেই একটা ছেঁড়া চাদর, ছেঁড়া কাঁথা, পরিত্যক্ত পায়জামা আর দুইটি পরিত্যক্ত ছেঁড়া ওড়না পড়ে আছে। তরুণরা হকচকিয়ে উঠে।

 

এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃদ্ধকে ৩/৪ জন তরুণ মিলে প্লাটফর্মের ছাউনিতে নিয়ে আসে। পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে তরুণরা জিজ্ঞেস করেন, চাচা, আপনার বাসা কোথায়? পরিবারের কারো মোবাইল নাম্বার দিতে পারবেন? বৃদ্ধ চুপ করে থাকে৷ মুখে জড়তা। চোখের কোণে এক ফোটা জল জমে আছে।

 

অস্পষ্ট স্বরে জানায়, তার নাম, নুর ইসলাম। নিজের মেয়ে ( শিল্পী) আর মেয়ের জামাই (মুকুল) এখানে ফেলে রেখে গেছে তাকে। আর নিতে আসবে না। তরুণরা বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি জানান, তামাকপট্টির বজলু মিয়ার ভাড়া বাসায় থাকতেন মেয়ে ও মেয়ের জামাই এর সাথে। তরুণদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করেন, চাচা, আপনার মেয়েকে যদি আমরা খুঁজে বের করি আপনি তার সাথে যাবেন? বৃদ্ধের চোখ ছলছল করে উঠে।

 

সব অভিমান লুকিয়ে স্রেফ জানিয়ে দেয়, বাবারা, আমি আমার মেয়ের সংসারে আর ঝামেলা করতে চাই না। আমার মেয়ের জামাই আমাকে দেখতে পারে না। আমাকে মারধর করে৷ আমার মেয়ের কাছেও আমি বোঝা হয়ে গেছি। আমি আর যাবো না। এখানেই থাকবো। বৃদ্ধ একরাশ অভিমান নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। যে সন্তানের জন্য এতো আত্মত্যাগ, এতো ভালোবাসা, এতো মায়া সেই সন্তানের কাছেই আজ তিনি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো আবর্জনা। যে বয়সে সন্তানের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার সময়, নাতী নাতনীদের সাথে খেলা করার সময় সেই সময়ে কি না তার মাথা গোঁজার জায়গা মিলে না। পরিত্যক্ত জামা ফেলে যাওয়ার পাশাপাশি নিজের জন্মদাতা বাবাকেও পরিত্যক্ত ভেবে ফেলে গেছেন রেলওয়ে স্টেশনে। তাও আবার নিজের সন্তান!

 

তরুণরা দ্বিধায় পড়ে যায়। এতো রাতে তাকে কোথায় রেখে যাবে সেটা নিয়ে দোটানায় পড়ে যায়। একজন ৯৯৯ এ কল দিয়ে ফতুল্লা থানার ডিউটি অফিসারকে সব জানায়। ডিউটি অফিসার বৃদ্ধকে খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করানোর কথা বলেন। তরুণরা বৃদ্ধকে নিয়ে খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। ফতুল্লা থানার ডিউটি অফিসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জকে বৃদ্ধ নুর ইসলামের সম্পর্কে অবগত করেন৷

 

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার এস আই আনোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, বৃদ্ধ নুর ইসলামের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। খানপুর ৩০০ সয্যা হাসপাতালের জরুরী বিভাগও খুবই দায়িত্বের সাথে তার চিকিৎসা করাচ্ছেন৷ যেসব তরুণরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন এবং আমাদের জানিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যেসব তরুণরা এই মহৎ কাজটি করলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন মাশারুল আফতাব খান রুদ্র। আড্ডাপ্রিয় ছেলে। অফিস শেষ করে চাষাড়া রেলওয়ে স্টেশনে আড্ডা দেয় কিছু সময়।

 

তিনি বলেন, বাবার বয়সী অসহায় একটা মানুষকে ওই অবস্থাতে রেখে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তার উপর ধুম বৃষ্টি। উপায় না পেয়ে কল করলাম ৯৯৯ নাম্বারে। সমস্ত কিছু শুনে আমাকে কানেক্ট করা হল ফতুল্লা থানার ডিউটি অফিসারের সাথে। তাঁদের সাথে পরামর্শ করে কিছু বন্ধু ও ছোট ভাইদের সহযোগিতায় নিয়ে গেলাম খানপুর হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক সাথে সাথেই ভর্তি করলেন তাকে।

 

এর মধ্যে ফতুল্লা থানার ডিউটি অফিসার ফোন দিয়ে জানালেন সদর থানার ওসি সাহেবকে জানানো হয়েছে ঘটনাটি, তিনি হাসপাতালে লোক পাঠাচ্ছেন। ডাক্তারের সাথে কথা বললাম, তিনি বললেন আপাতত স্যালাইন আর কিছু ওষুধ দিবেন তাকে সকালে কিছু পরীক্ষা করে তারপর ব্যাবস্থা নিবেন। আমার সাধ্য অনুযায়ী আমি কিছু ওষুধ কিনে দিলাম। সদর থানা থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর এলেন, যে সমস্ত তথ্যগুলো লোকটির কাছ থেকে জানতে পেরেছি তা প্রদান করলাম তাকে। তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি লোকটির একটা আশ্রয় দরকার কারণ তার সন্তানদের কাছেও সে নিরাপদ না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close