আইন ও অধিকারনারায়ণগঞ্জমতামত

নারায়ণগঞ্জে জোড়া খুন, মেধাবী ছাত্রের খুনি হবার নেপথ্যে দায় কার?

বিশেষ প্রতিনিধি,বজ্রধ্বনিঃ গত মঙ্গলবার ১ মার্চ ২০২২ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে তিনটি খুনের ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। এর মধ্যে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে নিতাইগঞ্জের ডালপট্টিতে মা ও তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে ধারালো ছুরি দিয়ে নৃশংস খুনের ঘটনা। বর্তমানে এই জোড়া খুনের ঘটনায় হওয়া মামলাটি ডিবি পুলিশের অধীনে তদন্তাধীন আছে।

 

 

যা ঘটেছিলঃআটক আল জুবায়েরের সঙ্গে থাকা ব্যাগে চারটি ছুরি ও কয়েকটি হ্যান্ড গ্লাভস পাওয়া গেছে। সঙ্গে স্বর্ণের চেইনও উদ্ধার করা হয়েছে। জুবায়ের নগরীর পাইকপাড়ার আলাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। এর আগে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ফারজানা আক্তার শিলা নামের এক নারীকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে জানা যায়, তিনি নিহত রুমা চক্রবর্তীর পুত্রবধূ। পুলিশের ধারণা, স্বর্ণালংকার ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে ওই যুবক রুমা চক্রবর্তী ও তার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তীকে হত্যা করেছে। রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। বিকেল পৌনে ৩টার দিকে তিনি স্ত্রীকে তার মোবাইলে ফোন করলে আটক যুবক ফোন ধরে। এ সময় সে ঘরের কোথায় স্বর্ণালংকার ও টাকা-পয়সা আছে তা জানতে চায়। পরিচয় জানতে চাইলে সে ফোন কেটে দেয়। পরে তিনি দ্রুত বাসায় গিয়ে দেখেন আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে আছে; মূল গেট বন্ধ। পুলিশ ভেতরে রয়েছে। রাম প্রসাদ বলেন, ‘আমার মেয়ে ঋতু ৬ মাস ১৬ দিনের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ওর স্বামীর বাড়ি চট্টগ্রামে। আমার স্ত্রী ও মেয়ের হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (তদন্ত) আমির খশরু বলেন, ‘আটক জুবায়েরকে নিহতদের পরিবারের কেউ চেনে না। ঘটনার পর জুবায়েরের ব্যাগ থেকে নিহত ঋতুর স্বর্ণের চেইন উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে চারটি ছুরি ও কয়েকটি হ্যান্ড গ্লাভস।’ প্রত্যক্ষদর্শী শংকর রায় বলেন, ‘হঠাৎ বাসার ওপর থেকে এক নারী দৌড়ে নিচে নেমে এসে চিৎকার করতে থাকে। এ সময় তার হাতে একটি বঁটি ছিল। এ কারণে লোকজন তাকে হত্যাকারী ভেবে বাইরে থেকে বাড়ির মূল গেট বন্ধ করে দিয়ে পুলিশে খবর দেয়।’ মা-মেয়েকে হত্যার অভিযোগে আটক মো. জুবায়ের।  সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ওই ভবনের নিচে গিয়ে আমরা ফারজানা আক্তার শিলা নামের এক নারীকে পাই। পরে ৬ তলায় গিয়ে বাসার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পাওয়া যায়। ধাক্কা দিলে ভেতর থেকে জুবায়েরের দরজা খুলে বাইরে আসে। তার হাতে ছুরি ছিল। পরে জিজ্ঞাসাবাদে সে মা-মেয়েকে হত্যার কথা স্বীকার করে।’ শীলা পুলিশকে বলেন, ‘অনবরত কলিং বেল বাজছিল। তখন আমি আর ঋতু ভেতরের রুমে ছিলাম। বাইরের রুমে ছিলেন মা। তিনি দরজা খুলে দেন। এরপরই মার চিৎকার শুনতে পাই। প্রথমে ঋতু দৌড়ে যায়। তখন লোকটা মাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছিল। ঋতু মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে লোকটা তাকেও ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এ সময় আমি হাতে বঁটি নিয়ে দরজা খুলে চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে আসি।’ পুলিশ কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘নিহত রুমার শরীরের ৬ জায়গায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তার মেয়ে ঋতুর শরীরের সামনে ও পেছনে তিনটি ছুরি ঢুকানো ছিল। আরও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সিআইডি ক্রাইম সিন ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে।’ পাশের ফ্ল্যাটের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ওই ভবনের নিচতলা থেকে ওপর তলা পর্যন্ত কয়েকটি ফ্ল্যাটের কলিং বেল চেপেছে জুবায়ের নামের ওই যুবক, কিন্তু কেউ দরজা খোলেনি। ওই যুবককে তারা আগে দেখেননি।

 

পুলিশ যা জানায়ঃজোবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।নারায়ণগঞ্জ জেলার এসপি জায়েদুল বলেন, “জোবায়ের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, লক্ষাধিক টাকা ঋণ হয়েছে তার। সেই ঋণের টাকা সংগ্রহ ও হতাশা থেকে অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুট করতে যান তিনি। এ কারণেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। ফ্ল্যাটে ঢুকে মা-মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, যুবক আটক নারায়ণগঞ্জে মা-মেয়ে খুন: গ্রেপ্তার জোবায়ের রিমান্ডে এ সময় এসপি আরও বলেন, জোবায়েরের বাড়ি থেকে ধর্মীয় সেসব বই জব্দ করা হয়েছে তাতে উগ্রজঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকার কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। মা ও মেয়েকে হত্যার পর ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ৯৯৯ ফোন করলে পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙে জোবায়েরকে আটক করে। এ সময় তিনটি রক্তমাখা ছুরি ও রক্তাক্ত দুটি গ্লাভস উদ্ধার করা হয়। জোবায়েরের ব্যাগ থেকে দুটি স্বর্ণের চেইন, কানের দুল উদ্ধার করা হয় বলে জানায় পুলিশ।

 

খুনি হবার ভুত মাথায় চাপার কারণঃ আটক জুবায়েরের বাবা আলাউদ্দিন মিয়া জানান, তিনি শহরের টানবাজারের লবণ ব্যবসায়ী। তার ছেলে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়। তবে আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় পড়ালেখা চালাতে পারেনি। এক-দেড় মাস ধরে তার ছেলে অস্বাভাবিক আচরণ করছিল।

 

বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিঃ রিপোর্টে প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি টানছি। কারণ বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। ডিজেল কেরোসিনসহ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণায় বাস সহ সকল পরিবহনের খরচ বাড়ে, সর্বশেষ সয়াবিন তেল নিয়ে চলছে মারাত্মক আয়নাবাজি। অন্যদিকে পেঁয়াজ আলু সহ বিভিন্ন মসলা নিয়ে আরেক লংকা কান্ড ঘটে বিভিন্ন সময়, এবার শীতের ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম চড়া ছিল। চাল ডালের দামও বাড়ন্ত। এই যখন অবস্থা তার মধ্যে ওয়াসার পানি গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। তাছাড়া এলপিজি গ্যাসের দাম নিয়ে চলছে প্রতিমাসে বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থরক্ষার প্রহসন। দেশের স্বাস্থ্য খাতের কি দৈন্যদশা তা করোনাকালে জনভোগান্তি দেখলেই বুঝা যায়। শেষে বলছি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার করুন হাল নিয়ে। করোনাকালে ২ বছরের অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে । আর্থিক সমস্যার ফলে অপরিণত বয়সে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত হতে বাধ্য হয় আরো অনেক শিক্ষার্থী। এরমধ্যে অনলাইন আসক্তি, ব্যবসায় ধ্বস, চাকরি হারানো বেকারত্ব ইত্যাদির মিশেলে বর্তমান সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধি দেখা দিয়েছে হতাশা। বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মানুষ এই হতাশাগ্রস্থ ব্যাধিতে আক্রান্ত। একদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মকে ব্যবহার করে একশ্রেণীর ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীর অপ-ব্যাখ্যা অন্যদিকে শিক্ষার্থীকে উৎপাদন বিচ্ছিন্নতা মৃত্যুকূপের সৃষ্টি করেছে। ফলে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে ধর্ষণ, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, ছিনতাই, চুরি এমনকি খুন করতে পর্যন্ত উদ্যত হচ্ছেন। সম্প্রতি চলচ্চিত্রের নায়ক রিয়াজের শশুর আত্মহত্যা করেন এবং সেটি নেট দুনিয়ায় ব্যাপক ঝড় তুলে। চলে নানান আলোচনা এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ। আসলে সেই ঘটনার বিবরণে আমরা জানতে পারি যে, তিনি ব্যবসায়িক ধ্বসে ঋণগ্রস্ত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ায় একাকীত্বে ভুগছিলেন যার সর্বশেষ পরিণতি তার আত্মহত্যা। আসলে এই কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য ঘাতক জুবায়ের এর অপরাধকে ছোট করে দেখা নয়। প্রকৃতপক্ষে অপরাধীর বিচার তদন্ত সাপেক্ষে মাননীয় আদালত এই করবেন। শুধুমাত্র এটুকুই উপলব্ধি যে, কোনো ঘটনায় বিচ্ছিন্ন নয়।

 

এই ছেলেটি মেধাবী ছিল, ধার্মিক ছিল। কিন্তু তার শিক্ষার ব্যয় ভার বহন, ব্যবসায় লোকসান করে ঋণগ্রস্ত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত ছিনতাই করতে গিয়ে খুনী হয়ে ওঠা!

এরকম একটি মেধাবী ছাত্রের খুনী হয়ে ওঠার নেপথ্যে দায় কার? তার পরিবারের! নাকি এই সমাজ/দেশ তথা রাষ্ট্র কে পরিচালনায় ব্যর্থ তাদের!

 

 

 

 

 

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close