অপরাধনারায়ণগঞ্জসিদ্ধিরগঞ্জ

আদমজী ইপিজেডে ব্যবসা দখল নিতে মরিয়া নরঘাতক নুর হোসেনের ভাই-ভাতিজা সহ ৩ কাউন্সিলর

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে কেন্দ্র করে এক ব্যবসায়ীর ম্যানেজারের ওপর দফায় দফায় হামলা করেছে কয়েকজন কাউন্সিলরের অনুসারীরা।

গত বুধবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেলে আদমজী ইপিজেডের ভেতরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে হামলায় গুরুতর আহত হন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা শাখার সভাপতি ইপিজেড ব্যবসায়ী আকতার হোসেনের ম্যানেজার মো: আকরাম হোসেন।

গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। যার নং-৪০।

জানা যায়, আদমজী ইপিজেডের সকল নিয়ম নীতি মেনে দীর্ঘ প্রায় ১০/১২ বছরের মতো সময় ধরে চেক পয়েন্ট সিস্টেম বিডি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করে আসছেন আকতার হোসেন।

গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) এর ০৩ জন কাউন্সিলর ইফতেখার আলম খোকন, নরঘাতক নুর হোসেনের ভাই কাউন্সিলর নুরুদ্দীন মিয়া ও নুর হোসেনের ভাতিজা নাসিকের আরেক বিতর্কিত কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল, নাসিক ৭নং ওয়ার্ডের পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী সালাউদ্দিন সানি সহ তাঁদের লোকজন বাইক মহড়া সহকারে আদমজী ইপিজেড এর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা যান। রপ্তানিমুখী এসব প্রতিষ্ঠানে নানা ঘটনায় আলোচিত সমালোচিত ০৩ কাউন্সিলরের হঠাৎ প্রবেশে ও তাঁদের লোকজনের বাইক সহকারে মহড়ায় প্রবল উদ্যেগ উৎকণ্ঠার জন্ম দেয় সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাঝে। অনেকেই হতাশা নিয়ে জানান ইপিজেড ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ টা হয়তো আর থাকবে না এরা প্রবেশ করলে। কারণ নরঘাতক নুর হোসেন কর্তৃক সাবেক নাসিক প্যানেল মেয়র নজরুল হত্যার দ্বন্দ্বের নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিলো এই ইপিজেড ব্যবসাও। ইপিজেড এর সাধারণ ব্যবসায়ীদের সে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ২৪ ঘন্টা না পেরোতেই রক্তাক্ত হতে হয় ইপিজেড ব্যবসায়ীর ম্যানেজার আকরাম কে।

গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টায় সিদ্ধিরগঞ্জ আটি এলাকার সাত্তার মোল্লার ছেলে সুমন মাহমুদ, কদমতলী এলাকার লাল মাহমুদের ছেলে লিমন শেখ (৩৫), জুয়েল, কামরুল সহ অজ্ঞাত ১৫/২০ জন যাদের অনেকেই উল্লেখিত ৩ কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত এসব কতিপয় সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যবসা কেড়ে নিতে হামলা করে গুরুতর যখম করে আকরামকে। এসময় সন্ত্রাসীরা ওই কারখানায় ইপিজেড ব্যবসায়ী আকতার হোসেনের ম্যানেজার আকরাম কে ব্যবসা থেকে সরে দাড়াতে বলে এলোপাথারি মারধর শুরু করে। এতে হামলায় আকরাম গুরুতর আহত হয়। পড়ে নানা ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে হামলাকারীরা ইপিজেড ত্যাগ করলে স্থানীয়রা গুরুতর আহত আকরামকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করেন।

আহত আকরাম জানান, আদমজী ইপিজেড এর চেক পয়েন্ট সিস্টেম বিডি লিমিটেড কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে আক্তার ভাই ব্যবসা করছে। আমাদেরকে এটাতে আর ব্যবসা না করার জন্য হুমকি দিয়ে অতর্কিতভাবে প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আমার উপরে লিমন, সুমন সহ ১৫/২০ জন সন্ত্রাসী এসে হামলা করে ও ব্যবসাটি ছেড়ে দিতে হুমকি ধামকি দেয়। আহত অবস্থায় আমার চিৎকার শুনে আমাকে বাঁচাতে লোকজন দৌড়ে আসলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।

এদিকে হামলায় আহত হয়ে আকরাম যখন হাসপাতালে ভর্তি এ সুযোগে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে উল্টো চেক পয়েন্ট এর ব্যবসায়ী আকতার হোসেনকে প্রধান আসামি করে বুধবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে সুমন মাহমুদ (৩৮) নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে আক্তারকে প্রধান আসামি এবং আরও ৫জনকে অজ্ঞাত করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেন।বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) সকালে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা।

মামলার বাদী সুমন মাহমুদ ফোনে বলেন, আমি চেক পয়েন্ট সিস্টেম নামক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে সাপ্লায়ার হিসেবে ব্যবসা করে আসছি। একসময় চেক পয়েন্ট প্রতিষ্ঠানটির ওয়েস্টেজ, সাপ্লাই সহ সব ধরনের ব্যবসা আমাদের ছিলো। পরবর্তীতে তারা জোরপূর্বক ভাবে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। কোম্পানির সাথে আমাদের ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তি ছিলো। তবে এ চুক্তি থাকাকালীন ২০১৮ সালে আকতার ক্ষমতার জোরে ওয়েস্টিজটা নিয়ে গেছে। তারপরও আমরা সাপ্লায়ার ও লেভার দেওয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। কিন্তু চেক পয়েন্ট প্রতিষ্ঠানটি নতুন আরেকটি ফ্যাক্টরি করেছে। সেখানে আমরা চাচ্ছিলাম কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে আমরা ওয়েস্টেজটা নিতে পারি কি না। মূলত আমরা গতকাল প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম আমাদের বকেয়া বিলের জন্য। সেখান থেকে বের হওয়ার পরই হামলা চালানো হয় আমাদের উপর।

এ বিষয়ে মামলার আসামি আক্তার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি কখনো ঝামেলা করি না। বেপজার সকল নিয়মনীতি মেনেই দীর্ঘদিন ধরে ইপিজেডে ব্যবসা করে আসছি। আদমজী ইপিজেডে রানিং ব্যবসা আমাদের। গত মঙ্গলবার নাসিকের তিন কাউন্সিলর বাদল, নূর উদ্দিন এবং খোকন এরা মহড়া দিলো এবং পরের দিন বুধবার আমার ম্যানেজারের ওপর সুমন মাহমুদ, লিমন সহ ১৫/২০ সন্ত্রাসী হামলা চালায়। গত ১৩ বছর ধরে আমি চেক পয়েন্ট সিস্টেম নামক প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করে আসছি। এখন উল্টো তারা আমার ম্যানেজারকে মারধর করে আমার নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে ইপিজেডে মহড়া ও হামলার বিষয়ে কথা হলে নাসিক ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইফতেখার আলম খোকন জানান, আমরা মঙ্গলবার কয়েকজন কাউন্সিলর মিলে ইপিজেডে গিয়েছিলাম বেপজার চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলার জন্য। তাঁর সাথে আমাদের আলাপ আলোচনা হয়েছে। আমরা ব্যবসা করার সুযোগ চেয়েছি। ইপিজেডে সকল ব্যবসায়ীর ব্যবসা করার অধিকার রয়েছে। এখানে কাউকে বাঁধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। টেন্ডারে যার নাম উঠবে সেই ব্যবসা করবে। ব্যবসায়ীর ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, পানি আকতার নামে একজনের সাথে ঝামেলা হয়েছে শুনেছি। আকতারের বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে চাই না। সে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করে জানি। এর আগেও অনেকবার ইপিজেডে সে ঝামেলা করেছে।

এদিকে দিনে দুপুরে ব্যবসা কেড়ে নিতে ইপিজেড ব্যবসায়ীর ম্যানেজারের উপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইপিজেডের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, একটি চক্র আদমজী ইপিজেড এর শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা বাইক সহকারে মহড়া দিচ্ছে।ইপিজেড গেটে অবস্থান নিয়ে আমাদেরকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার জন্য নানা হুমকি দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছে ব্যবসা দেয়ার জন্য। আদমজী রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বেপজা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে যারা ব্যবসা করে বৈধভাবে লাইসেন্স নিয়ে নিয়ম নীতি মেনে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু আজকাল কিছু কুচক্রীমহল ব্যবসা কেড়ে নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। ইপিজেডে প্রবেশ করে মারধর করছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।

উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার ফাঁসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত দেশব্যাপী বহুল সমালোচিত নুর হোসেনের ভাই বিএনপি নেতা নূর উদ্দিন মিয়া ও ভাতিজা একাধিক মামলার আসামী শাহজালাল বাদল বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সেভেন মার্ডারের পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান নুর হোসেন। নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ার পর শিমরাইল মোড়ের ট্টাক স্টান্ডের তার আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করেছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নূর হোসেন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সেই সময় তার সকল ক্যাডার, সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দেয়। ঐ সময় নূর হোসেনের ভাই নুর উদ্দিন ও ভাতিজা শাহজালাল বাদলও পালিয়ে গিয়েছিলো নুর হোসেনের সাথে। দীর্ঘদিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকার পর নুর হোসেনের ভাই নূর উদ্দিন ও ভাতিজা শাহ জালাল বাদল এলাকায় ফিরে এসে তাদের সাম্রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা করে।

বিএনপির সূত্রে জানা যায়, নূর উদ্দিন দীর্ঘদিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। পরবর্তীতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির যুগ্মা-আহ্বায়ক হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে শতশত ক্যাডার নিয়ে যোগদান করেন নুর উদ্দিন। সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র, নাশকতা, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামী নুর উদ্দিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close