নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জে অগ্নি ঝুঁকিতে ৩৪ শিল্পকারখানা
শিল্প নগরী খ্যাত জেলা নারায়ণগঞ্জ। দেশের জিডিপিতে যে জেলার ভূমিকা রয়েছে ব্যাপক। কিন্তু জেলার শিল্প ব্যবস্থায় উন্নতি হলেও শিল্পের বিকাশে যারা অক্লান্ত শ্রম দেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে। কারণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা না মেনে তৈরী হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জেলা ফায়ার সার্ভিসের সূত্রমতে, অগ্নিনির্বাপণ বিধি মেনেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। ঝুঁকিপূর্ণ কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা অনুযায়ী ফায়ার এক্সিট (অগ্নিকান্ডের সময় নিরাপদে বের হওয়ার বিকল্প পথ), ফায়ার অ্যালার্ম (আগুনে সতর্ক করিবার জন্য যন্ত্রবিশেষ), স্মোক ডিটেক্টরের (ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র), সেফটি ট্যাংক নেই। এছাড়া নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় কনটিনজেন্সি প্ল্যান রাখা জরুরি হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শনের সূত্র অনুযায়ী, জেলার শিল্প অধ্যুষিত ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জে পরিদর্শন পরবর্তী ৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাহিরে জেলার ঝুঁকিপূর্ণ হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে কয়েক হাজার। রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অসংখ্য ছোট-বড় কলকারখানা। তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফতুল্লা থানার রয়েল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সায়েম ফ্যাশন, নাদীয়া নীট ডাইং, তারা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, দি একমি ল্যাবরটরিজ লিমিটেড, বিকন নীট ওয়্যার লিমিটেড, ড্রিম ইয়ার্ড এ্যাটেয়ার্স লিমিটেড, পি আর এস টেক্সটাইল, সুপার স্টার ইলেকট্রিক্যাল এন্ড এক্সসরিজ, ইউরো নীট স্পীন লিমিটেড, ইউরোটেক্স নীট ওয়্যার লিমিটেড, টেক্স এশিয়া লিমিটেড, ফাইভ এস কম্পোজিট লিমিটেড, মেসার্স মদিনা ডাইং এন্ড প্রিন্টিং, বিসিক শিল্প নগরীর সিহাব নীটওয়্যার, আর এস প্যাকেজিং এন্ড এক্সসরিজ, মেসার্স খান ব্রাদার্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। তল্লা এলাকার গোমতী নীট ওয়্যার লিমিটেড, সাদিয়া ফ্যাশন লিমিটেড, রাইন ড্রেজ লিমিটেড। হাজীগঞ্জ এলাকার ওশান কালার, স্টেপটু রেইনবো ইউনিট-২।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এইচ কে এ্যাপারেলস লিমিটেড, গ্রীন গার্ডেন সুয়েটার, ডেজলিং টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়েষ্ট এ্যাপারেলস লিমিটেড, ইব্রাহিম কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেড, এ্যাডভান্স কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড, ফোর নীট ওয়্যার লিমিটেড, নিউ রিচুলী এ্যাপারেলস লিমিটেড, রকি টেক্সটাইল মিলস্ প্রাঃ লিমিটেড, বর্ণালী টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রিজ প্রাঃ লিমিটেড, সাকুরা ডাইং এন্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, সুবর্না টেক্সটাইল।
জানা যায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানে কোটি টাকা আয় হলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সামান্য অর্থ ব্যয় করতে নারাজ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ফলরূপ, প্রতি বছর জেলাজুড়ে মর্মান্তিক অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে শ্রমিকেরা। গত বছর রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ আগুনে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর তদন্তে উঠে আসে দুর্বল তদারকি আর নিরাপত্তা অবহেলার চিত্র।
নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের সূত্রমতে, জেলায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স ভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪ হাজার ৯০১টি। এর মধ্যে চলমান রয়েছে ৩ হাজার ৫০০টি প্রতিষ্ঠান। লাইসেন্স বিহীন রয়েছে অগনিত প্রতিষ্ঠান, যাদের নেই কোন লাইসেন্স। যেখানে শ্রমিকদের অধিকারে নেই নূন্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, জেলায় একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ভাড়া ভবনে চলছে। তাদেরকে একাধিকবার ঝুঁকিপূর্ণ নোটিশ দেওয়া হলেও তারা কোনরূপ পরিবর্তন করে না। মামলা হলে ভবন স্থানান্তর করে। যেসব প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে, সেসব প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া এ বিষয়ে বলেন, নারায়ণগঞ্জে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার কলকারখানা লাইসেন্সভুক্ত। কারণ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স পেতে হলে ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্সসহ একাধিক লাইসেন্স এর প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের এসব লাইসেন্স নেই। আমরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে এই অর্থবছরে একাধিক আইনে ১০২টি মামলা করেছি। শহরের হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। এ ধরনের বিষয় একাধিকবার জেলা প্রশাসনের সভায় জানানো হয়েছে। আমাদের দপ্তর থেকে বড় জোর কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি। এর পরবর্তী যেকোন ব্যবস্থা প্রশাসন গ্রহণ করবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জেলার কল-কারখানার অগ্নি সংক্রান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে বলেন, আমরা জেলার কল-কারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করে থাকি। এসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের আত্মরক্ষার জন্য মহড়া করি। এর মধ্যে পরিদর্শন পরবর্তী যেসব প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে সেগুলোকে নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশ পেয়েও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলে আমরা প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করি। অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল ব্যবস্থা দেখেই তাদের লাইসেন্স দিয়ে থাকি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার এ বিষয়ে বলেন, জেলার আইন শৃঙ্খলা সভায় কলকারখানার অগ্নিঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। কলকারখানার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করতে বলা হয়। এছাড়া কলকারখানা পরিদর্শনের জন্য একটি বিশেষ দলও রয়েছে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে উবর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। শীগ্রই এসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।