জাতীয়সিলেট বিভাগ

সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ান— ওলীউর রহমান

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের অধিকাংশ উপজেলার মানুষজন একেবারে নাজেহাল। টানা বৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে এই দুটি জেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষগুলো নিতান্ত কাবু হয়েপড়েছেন। একেতো কিছু দিন আগের বন্যায় পাকা ধানে ভরা মাঠ তলিয়ে গেছে পানির নীচে, মাছের খামার, নার্সারী ইত্যাদি ভেসে গেছে বানের পানিতে। এছাড়া প্রথমবার বন্যায় যাদের বাড়ি ঘর নস্ট করে দিয়েছে তারা বসত ভিটাকে বসবাসের উপযোগী করতে না করতে আবারো বন্যায় নিমজ্জিত করে দিয়েছে সব কিছু।
পানিবন্ধী এলাকাগুলোতে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেক আশ্রয় কেন্দ্রও তলিয়ে গেছে পানির নীচে। সেখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নেই রান্না করার জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানী কাঠ এবং এক তিলকে শুকনো জায়গা। অনেক হাস-মুরগি ও গবাদি পশু হারিয়ে গেছে, ভেসে গেছে বানে পানিতে। গরু ছাগলগুলো নিয়ে কৃষকেরা পড়েছেন মারাত্মক বেকায়দায়। স্ত্রী সন্তানদের চিন্তা করবেন না গরু বাছুরের কথা চিন্তা করবেন। চোখের সামনে মূল্যবান সম্পদগুলোর দুর্বস্থা দেখে হাউমাউ করে বিলাপ করছেন অসহায় গৃহস্তরা।
থামছেনা টানা বৃষ্টি, চোখের সামনে নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক স্বপ্ন, পানিবন্দী মানুষের চোখে বোবা দৃষ্টি। সামনে শুধু অন্ধকার। কিছুই ভেবে পাচ্ছেননা, কী করবেন, কোথায় যাবেন? সামনে যেন কেবলই অন্ধকার। অবশেষে নিজের ও পরিবারের লোকদের জীবন রক্ষা করতে অনেক আসবাব পত্র, মূল্যবান সম্পদ, অনেক পরিবারের গোলাভরা ধান ইত্যাদি পেছনে রেখে নিজেদের জীবন রক্ষার তাকিদে ছুটে চলেছেন কোন আশ্রয়ের দিকে। এখানেই শেষ নয়, যেখানে এসে উঠেছেন কিছুক্ষণ পর হয়ত সেখানে এসেছে বন্যার পানি। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছেনা। বিপদের উপর বিপদ। এই ছিল পানিবন্দী লাখ লাখ পরিবারের অবস্থা।
তাছাড়া অধিকাংশ পানিবন্দী এলাকাগুলোর সাথে প্রায় সব রকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। স্থল পথের যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি মোবাইলেও ঠিকমত যোগাযোগ করা যায়নি। ইন্টারনেট সার্ভিসও ছিল অচল। পরিবারের একেকজন একেক জায়গায়, কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা। এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মনে হচ্ছিল মোবাইল কোম্পানীগুলোর নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা একবারে ভেঙ্গে পড়েছে। এর কারণ সুস্পষ্ট নয়। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারগুলো বন্ধ হয়েগেছে, যার কারণে মোবাইলের নেটওয়ার্ক প্রব্লেম হয়েছে এবং ইন্টারনেট সার্ভিসও অচল হয়ে পড়েছে। এসব খোড়া যুক্তি দিয়ে তারা জনগণকে প্রবোধ দেয়ার চেস্টা করেছেন। মূলত এখানে অন্য কোন রহস্য ছিল কিনা? এবিষয়টি ভাল করে খতিয়ে দেখা দরকার। মোবাইল কোম্পানীগুলোর এই লোকোচুরীর মূল কারণ কী?
বানভাসি মানুষেদের উদ্যার করা, তাদের সাথে যোগাযোগ করা এবং ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো ইঞ্জিন নৌকা। কিন্তু প্রয়োজনের তূলনায় তাও একেবারে অপ্রতুল। তাছাড়া অধিকাংশ ইঞ্জিন নৌকার মাঝি ভাড়া চান সীমাহীন। যেখানে নিয়মিত ভাড়া পাঁচশত টাকা সেখানে তারা চার্য করে দশ হাজার টাকা। এই সুযোগে তারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এই বন্যা এই মাঝিগুলোর আরেক কুৎষিত চেহারা প্রকাশ করে দিয়েছে। অবাক হচ্ছেন? আমি মাঝিদের এই আচরণে মোটেও অবাক হইনি, কারণ এমন সুযোগ আমাদের সমাজে কেউই হাতছাড়া করতে চায়না। ড্রাইভার বলেন, ব্যবসায়ী বলেন, ডাক্তার বলেন, উকিল বলেন, পুলিশ-প্রশাসন, শিক্ষাবিদ এমনকি জনপ্রতিনিধি- আজ কাল কেউই সুযোগ হাত ছাড়া করেনা। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সবাই। সমাজটা যেন পঁচে গেছে। নেতা-পাতি নেতা, মাজারি ও বড় নেতা সবারই মনে হয় এক ক্ষুর দিয়ে মাথা কামানো। সমাজের এই নৈতিক অধ:পতন কে ঠেকাবে?সমাজের উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা যদি কারণে অকারণে মানুষকে বিভিন্ন ফাদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে পারেন, তাহলে অশিক্ষিত অল্প শিক্ষিত মাঝিরা যে সুযোগ হাত ছাড়া করবে তা তো কল্পনাও করা যায়না। যে সমাজের উচ্চ শিক্ষিতরা অনায়াসে অপরাধ করে সে সমাজের সাধারণ অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিতরা অপরাধকে অপরাধ মনে করবে কিভাবে? মানবতা, সমাজসেবা, মানুষ মানুষের জন্য- এসব কথা এখন শুধু কিতাবে আছে, বক্তৃতায় এবং পত্রিকায় শোভা পায়। বাস্তবে এসবের কার্যকারিতা খুবই কম। ব্যতিক্রম যে নেই আমি সে কথা বলছিনা। এখনো বহু মানুষ আছেন যারা লাখ লাখ টাকা অকাতরে মানব সেবায় বিলিয়ে দিচ্ছেন, নীরবে নিভৃতে জীবনের ঝুকি নিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এরাই প্রকৃত মানুষ। এদের প্রতি হাজার সালাম।
বিপদের সময় যে পাশে দাঁড়ায়, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় সেই প্রকৃত বন্ধু, সেই প্রকৃত মানুষ। দুর্গত এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করার দরকার। মানুষ হাহাকার করছে, গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছছেনা। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতা মাঠে খুব কম দেখা যাচ্ছে। অনেক জনপ্রতিনিধিকে এলাকায় খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। দয়া করে আপনারা মাঠে নামুন, মানুষের পাশে দাঁড়ান, মানুষকে বাচান।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের দরকার। তাদের ঘর মেরামত ও বসবাসের উপযোগী করার জন্য টাকা দরকার, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, দিনমজুর, জেলে ও ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য অনেক সহযোগিতার দরকার। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকেও ঠিকঠাক করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এজন্য সমাজের সকল সামর্থবান ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল, সংস্থা, সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে, সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। মনে রাখবেন, জাতির সামনে এই বন্যা এক কঠিন পরীক্ষা, ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে এই পরীক্ষায় কে কিভাবে অংশ গ্রহণ করছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন।
ত্রাণ তৎপরতায় এ পর্যন্ত দেশের তরুণ আলেম সমাজ বিরাট অবদান রাখছেন। বিগত করোনা পরিস্থিতিতেও তরুণ আলেম- মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনগণের এবং বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংস্থার দায়িত্বশীলদের অবদান ছিল প্রশংসনীয়। প্রবাসীরা বড়দাগের সহযোগিতা করছেন। আবার কেউ কেউ ত্রাণ বিতরণ করছেন কেবল ফটো শেষনের জন্য, দয়া করে এসব পরিহার করুন। অসায় মানুষের অসহায়ত্বকে নিয়ে উপহাস করবেননা। এই অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নাই। ত্রাণ বিতরনের ছবি অবশ্যই প্রচার করতে পারবেন কিন্তু মানুষের মান মর্যাদার প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এই বন্যা অনেক সম্মানী মানুষকে পথে বসিয়েছে, তাদের মান মর্যাদাকে আপনি নিলামে তুলবেননা। আসুন আমরা বিপদগ্রস্ত লাখ লাখ পানিবন্দী মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাদের পাশে দাঁড়াই। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।

ওলীউর রহমান
কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, সিলেট
মোবাইল: 01714608726

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close