নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জে অভিনয়ের মাধ্যমে ইজিবাইক ছিনতাই

নারায়ণগঞ্জে অভিনয়ের মাধ্যমে তিন পদ্ধতিতে ২৫০টির অধিক অটোরিক্সা বা ইজিবাইক ছিনতাই করেছে চোরাই চক্রের সদস্যরা। যার রহস্য উৎঘাটন করেছে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ।

বুধবার দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান গত ৬ সেপ্টেম্ব বিকালে ফতুল্লার নরসিংহপুর কাউয়াপাড়া জাহাঙ্গীর এর গ্যারেজ হতে প্রতিদিনের মত ব্যাটারী চালিত মিশুক নিয়ে বের হয়ে যান মোঃ আঃ কুদ্দুস। কিন্তু রাতে বাসায় না ফেরায় এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় ভিকটিমের স্ত্রী অনেক খোজাখুজিঁর পর ভিকটিমকে কোথাও খুজে না পেলে ফতুল্লা থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করেন যার নং-১০৬০, তাং-১৮/০৯/২০২১ ইং। ডিআইজি পিবিআই বনজ কুমার মজুমদার এর সঠিক তত্ত্বাবধানে ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই নারায়নগঞ্জ ইউনিট ইনচার্জ মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম পিপিএম এর সার্বিক দিক নির্দেশনায় এস.আই মাজহারুল ইসলাম এবং এস.আই শাকিল হোসেন থানা পুলিশের পাশাপাশি উক্ত জিডি নিয়ে ছায়াতদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা থাকায় পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার সহায়তায় ভিকটিমের স্ত্রী মোছা- রীনা খাতুন বাদী হয়ে অপহরণ মামলা দায়ের করলে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলা মামলাটি স্ব-উদ্যগে গ্রহন করে। মামলাটি তদন্তভার গ্রহন করার পরপরই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস.আই মাজহারুল ইসলাম এবং তার সহযোগী এস.আই শাকিল হোসেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মামলার ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বন্দর থানার ধামগড় ইউনিয়নের চৌরার বাড়ির মৃত আব্দুল সালামের ছেলে সিদ্ধিরগঞ্জ হীরাঝিল এলাকার ভাড়াটিয়া শাহ আলম (৩৮), বরগুনা জেলা সদরের আমতলীর মৃত নূরুল ইসলামের ছেলে হালিম (৪২), পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার জোলাগাতির আব্দুল খালেকের ছেলে মো. শহিদুল (৩২), বরগুনা জেলা সদরের বউঠাকুরানী এলাকার মৃত আব্দুর রবের ছেলে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীর ভাড়াটিয়া বাদশা (৪৭), সোনারগাঁ থানার আট নম্বর ওয়ার্ড হাতুরাপাড়ার সালাম মিয়ার ছেলে মো. আসলাম (৩০) ও একই থানার তিন নম্বর ওয়ার্ড পেঁচাইন এলাকার মৃত আলী আকবরের ছেলে মো. মনির (৪০)।

গ্রেফতারকালে আসামী শাহ আলম এর কাছ থেকে ভিকটিম আঃ কুদ্দুস এর মোবাইল এবং ছিনতাই কাজে ব্যবহার করা একটি ডাবল ডেগার (সুইচ গিয়ার চাকু) জব্দ করা হয়। তাদের কে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আসামীরা তাদের অটোরিক্সা-ইজিবাইক ছিনতাইয়ের অভিনব কৌশলের কথা জানায়। আসামীদের ভাষ্যমতে,তারা মূলত ৮/১০ জনের একটি গ্রুপ নারায়নগঞ্জ জেলা সহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় অটোরিক্সা-ইজিবাইক, অটো মিশুক ছিনতাই করে থাকে। চক্রটি মূলত ০৩টি পদ্ধতিতে কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে।
অভিনব কৌশল-০১ (সাহেব-দাড়োয়ান অভিনয় করে অটো চুরি)ঃ এই পদ্ধতিতে চক্রের একজন সদস্য শহরের যে কোন একটি বাসার সামনে বাসার কেয়ারটেকার/দাড়োয়ান হিসেবে দাড়িয়ে থাকবে এবং একটি রিক্সা ডেকে আনবে। ঐসময় চক্রের আরেকজন সদস্য বাড়ীর মালিক হিসেবে দাড়োয়ানের সামনে আসবে এবং দাড়োয়ানের সাথে কুশল বিনিময় করবে (যেমনঃ গ্যাস বিল দেয়া হয়েছে কী না, পানি ওঠানো হয়েছে কী না, গাড়ী কোথায়, গেট খোলা কেন ইত্যাদি)। দাড়োয়ান এবং বাড়ীর মালিক অভিনয় করে ভিকটিম রিক্সাচালকের মনে চক্রের একজনকে দাড়োয়ান এবং অপরজনকে বাড়ীর মালিক হিসেবে বিশ্বাস সৃষ্টি করাই মূল লক্ষ্য থাকে। অতঃপর বাড়ীর মালিকের অভিনয় করা চক্রের সদস্য দাড়োয়ানের সাথে কথা শেষ করে রিক্সায় ওঠে এবং গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। কিছুদুর যাওয়ার পর রিক্সায় ওঠা চক্রের সদস্যর মোবাইলে কল আসবে এবং সে মিথ্যা অভিনয়ে কথা বলবে। কথা বলার একপর্যায়ে সে রিক্সা থামাবে এবং টার্গেট ভিকটিম রিক্সাওয়ালাকে তার দাড়োয়ানকে দ্রুত ডেকে আনার জন্য বলবে। রিক্সাওয়ালা ঐ যাত্রীকে বাড়ীর মালিক ভেবে রিক্সা রেখে দাড়োয়ানকে ডাকতে গেলে ঐ স্থানেই পূর্ব থেকে দাড়িয়ে থাকা চক্রের অপর ড্রাইভার সদস্য রিক্সাসহ বাড়ীর মালিকবেশী যাত্রী নিয়ে চলে যায় এবং ঐদিকে ভিকটিম রিক্সাওয়ালা দাড়োয়ানকে খুজঁতে গেলে দাড়োয়ান আগেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরবর্তিতে তারা রিক্সাটি তাদের নির্দিষ্ট চোরাই গ্যারেজে বিক্রি করে দেয়।

অভিনব কৌশল-০২ (নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে অটো ছিনতাই)ঃ এই পদ্ধতিতে তারা যে অটোরিক্সাটি টার্গেট করে সে অটোরিক্সাটিকে চোরচক্রের একজন দাড়োয়ান সেজে অটোরিক্সাটি ডাকে, একজন কোট-টাই পরিহিত সাহেব হিসেবে অটোরিক্সার যাত্রি সাজে, অন্য আরও দুইজন সাহেবের বন্ধু হিসেবে অটোরিক্সায় উঠে চালকের চাহিদামত ভাড়ায় রাজি হয়ে চক্রের পূর্বপরিকল্পিত স্থানে যেতে বলে। পথিমধ্যে তারা সুবিধাজনক স্থানে নেমে ড্রাইভারের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য ড্রাইভারকে চা খাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ঐসময় তারা সু-কৌশলে ড্রাইভারের চায়ের মধ্যে চেতনানাশক/ উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। চা খাওয়ার পর তারা ইবার গন্তব্যেও উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ড্রাইভার আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পরলে ছিনতাইকারী চক্রের পূর্বনির্ধারিত প্রশিক্ষিত ড্রাইভার গাড়ীর নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। পরবর্তিতে তারা তাদের সুবিধাজনক নির্জন স্থানে গিয়ে চক্রের সদস্য কোট-টাই পরিহিত সাহেব ভিকটিম ড্রাইভারকে নিয়ে নেমে যায় এবং চক্রের ড্রাইভার সদস্য সহযোগী সদস্যকে নিয়ে গাড়ীটি তাদের পূর্বনিধারিত চক্রের অপর সদস্য চোরাই গাড়ীর ক্রেতার কাছে নিয়ে গাড়ীটি বিক্রি করে দেয়। এরপর চোড়াই গাড়ীর ক্রেতা গাড়ীটিকে যাতে মূল মালিক সনাক্ত করতে না পারে সেজন্য তাদের নির্ধারিত গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে গাড়ীটির রং-পরিবর্তনসহ আনুসাঙ্গিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে অধিক দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ভিনব কৌশল-০৩ (অপহরন/খুন করে অটো ছিনতাই)ঃ এই পদ্ধতিতে তারা পদ্ধতি-০১ এর মত কৌশল করেই অটোরিক্সা ভাড়া করে তাদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে যাওয়ার চেষ্টাকালেই কখনো যদি ঐ ড্রাইভার ছিনতাই চক্রের কৌশল বুঝে ফেলে কিংবা কোন সন্দেহ তৈরি হয় তখন ঐ ড্রাইভার তাদেরকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে ছিনতাই চক্রের সদস্যগন প্রথমে উক্ত ড্রাইভারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অটো ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। পরবর্তিতে গাড়ীর ড্রাইভার ছিনতাই চক্রকে গাড়ীটি ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তাৎক্ষনিক তাকে উর্পযুপরি ছুড়িকাঘাত করে মৃত অথবা অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে দিয়ে গাড়ীটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

আসামীদেরকে গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আসামীরা তাদের অটোরিক্সা-ইজিবাইক ছিনতাইয়ের অভিনব কৌশলের কথা জানায়। তারা জানায় মামলার ভিকটিমের ক্ষেত্রে তারা তাদের পদ্ধতি-০১ অবলম্বন করে ঘটনার দিন ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা অনুমান ৭ টায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ছিনতাই চক্রের সদস্য আসামী শাহ আলম, হালিম এবং রাশেদ ওরফে রিয়ন ভিকটিম মিশুক চালক আঃ কুদ্দুসকে নারায়ণগঞ্জ জেলার চিটাগাং রোড স্ট্যান্ড থেকে ৫০০ টাকা ভাড়ায় কালীবাজারে আপ-ডাউন যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে তারা আদমজী এলাকায় ভিকটিম ড্রাইভারকে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত চায়ের দোকানে নিয়ে চা খেয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। তারা নারায়ণগঞ্জ সদরের তানবাজারে গিয়ে ৩০০ টাকায় আধা লিটার মদ কিনে। মদ কেনার পর তারা খানপুর হাসপাতালের আশপাশের স্থানে গিয়ে নিজেরা মদ খায় এবং ভিকটিম ড্রাইভারকে মদ খাওয়ার প্রস্তাব দিলে ড্রাইভার মদ খেতে রাজি হলে কৌশলে আসামী শাহ আলম মদের মধ্যে উচ্চমাত্রার ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। ঔষধ মেশানো মদ খাইয়ে ড্রাইভারসহ তারা আবার চিটাগাং রোডের দিকে যাত্রা শুরু করে। মদ খাওয়ার ২০-২৫ মিনিট পরে আস্তে আস্তে ড্রাইভার অচেতন হয়ে পড়লে আসামী শাহ আলম ড্রাইভারকে নিয়ে আদমজী এলাকার বিহারী পট্টিতে নেমে পড়ে এবং ভিকটিমকে বিহারী পট্টিতে ময়লার ভাগারের পাশে রেখে চলে যায়। চক্রের অপর ড্রাইভার সদস্য হালিম এবং তার সহযোগী আসামী রাশেদ ওরফে রিয়নকে নিয়ে তাদেও পূর্বনির্ধারিত চোরাই গাড়ীর ক্রেতা আসামী আসলামের কাছে গাড়ীটি ৩৬০০০/- টাকায় বিক্রি করে দেয়। আসামী আসলাম গাড়ীটির রং, সীট কভার এবং হুড চক্রের অপর সদস্য আসামী মনিরের মাধ্যমে পরিবর্তন করে ফেলে। উক্ত ছিনতাই চক্রের সকল আসামীদের গ্রেফতার করার পর তাদের দেয়া তথ্যমতে ছিনতাই হওয়া মিশুক অটো রিক্সাটি আসামী আসলাম এবং মনিরের যৌথ গ্যারেজের পেছন থেকে উদ্ধারপূর্বক জব্দ করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close