জাতীয়মতামতরাজনীতি

ইতিহাসের মহানায়কের জীবনাবসান,সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ মারা গেছেন। শনিবার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। সাহাবুদ্দীনের এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং আরেক মেয়ে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। আর দুই ছেলে বাবার সঙ্গেই থাকেন। বড় ছেলে শিবলী আহমদ একজন পরিবেশ প্রকৌশলী। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ২০১৮ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান সাহাবুদ্দীন আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা আহমদ।

 

শনিবার দুপুরে ঢাকা থেকে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় সাহাবুদ্দীনের লাশ। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম জানাজা। এরপর বিকালে তার লাশ আনা হয় রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসায়। রাতে তার লাশ রাখা হয় সিএমএইচ হাসপাতালের হিমঘরে। আজ সকালে সাহাবুদ্দীনের লাশ নেওয়া হবে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজার পর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার জন্য তার লাশ সেখানে কিছুক্ষণ রাখা হবে। পরে বনানীতে স্ত্রীর কবরের পাশে তার লাশ সমাহিত করা হবে।

২০০১ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ঢাকার গুলশানের বাড়িতে অনেকটা নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।

যেভাবে হলেন ইতিহাসের অংশ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নায়ক তিনি। যদিও তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তবে এ দেশের রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তনে তিনি বিশাল অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে আইনাঙ্গনেও তার অবদান রয়েছে। আইনের ছাত্র না হয়েও তার মেধা, প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান হন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের পতন যখন প্রায় আসন্ন তখন রাষ্ট্রপতির পদে কে আসবে, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন-সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলো (তিন জোট) একমত হতে পারছিল না। দফায় দফায় বৈঠকের পর প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। কিন্তু সেই সময়ের প্রধান বিচারপতির পদে থাকা সাহাবুদ্দীন আহমদ এ ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দেন। নির্বাচনের পর তাকে ফের সুপ্রিমকোর্টে ফিরিয়ে আনা হলেই তিনি এতে রাজি হবেন। তার সে শর্ত মেনে নেওয়া হয়। পরে ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের মুখে তখনকার উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে তাকে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দেশের ক্রান্তিকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। পরে তার নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে বেশ প্রসংশিত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে ওই বছর ১০ অক্টোবর আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন তিনি। সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ দুটি বিষয়কে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। চাকরির মেয়াদ শেষে ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতির পদ থেকেই অবসরে যান তিনি।

রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও তার আচরণে, তার দায়িত্ব পালনের মধ্যে এর কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। অঙ্গীকার পূরণ করেছেন একনিষ্ঠভাবে, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সব মোহের ঊর্ধ্বে থেকেছেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা প্রয়োজন ছাড়া রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে আসেননি। রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত অন্য কোনো কিছু তিনি গ্রহণ করেননি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিদেশে অবস্থানরত ছেলের সঙ্গে টেলিফোন-কথোপকথনের সতেরশ টাকার বিল তিনি নিজে দিয়েছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তৃতা বা অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও ক্যাসেট করিয়ে তার খরচ দিতে না পারলেও (এমন কোনো নিয়ম নেই বলে) একটি নতুন ভিডিও ক্যাসেট দিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে। বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সরকারি তোশাখানায় জমা দিয়েছেন নিয়ম অনুযায়ী। এসবই আমাদের দেশের যে কোনো স্তরের একজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া দুর্লভ।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই দলের প্রার্থী হিসাবে সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। তবে ২০০১ সালে নির্বাচনে হারের পর আওয়ামী লীগের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি বেশকিছু কঠোর আইন সংশোধন করেছিলেন, যা দেশের সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

বিভিন্ন মহলের শোক : সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। এছাড়া শোক জানিয়েছেন-জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম (গোলাম মোহাম্মদ) কাদের, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি।

শিক্ষা ও কর্মময় জীবন : বাংলাদেশের ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে। তার বাবা তালুকদার রিসাত আহমেদ ভূঁইয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসেবক। সাহাবুদ্দীনের শৈশব কাটে নান্দাইলে বোনের বাসায়। তিনি ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চণ্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন সাহাবুদ্দীন। ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন তিনি। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার হিসাবে নিয়োগ পান সাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারক হিসাবে পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। বিচারপতি হিসাবে তার প্রদত্ত বহু রায় প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তার প্রদত্ত রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসাবে স্বীকৃত। সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে তৎকালীন সরকার তার সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়।

কেন্দুয়ায় গ্রামের বাড়িতে প্রথম জানাজা : নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, শনিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে হেলিকপ্টারে সাহাবুদ্দীন আহমদের লাশ কেন্দুয়া হেলিপ্যাড মাঠে নিয়ে আসা হয়। পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের পেমই গ্রামে নেওয়া হয়। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে সেখানে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জিয়া আহমেদ সুমন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন আহমদ, কেন্দুয়ার পৌর মেয়র আসাদুল হক ভূঁইয়াসহ কয়েক হাজার মানুষ এতে অংশ নেন। এর আগে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। জানাজা শেষে তার লাশ আবার ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা এম উসমান গণি তালুকদার ও সাইফুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে তিনি গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি খুব নির্লোভ মানুষ ছিলেন। বাড়িতে তার একটি ঘরও নেই। তেমন কোনো জমিজমাও নেই। কোনো আত্মীয়স্বজনকে কোনো কিছু করে দেননি। তিনি বলেছিলেন বাড়ি আসবেন। এসে অনেকদিন থাকবেন। তা আর হলো না।

সাহাবুদ্দীনের ছেলে সোহেল আহমদ বলেন, বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ হলো না। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে এসে কদিন থাকবেন। আমার বাবা নীতি আদর্শের বাইরে কোনো কাজ করেননি। কোনো শক্তির কাছে মাথানত করেননি। একেবারেই সাদামাটা জীবনযাপন করেছিলেন তিনি। আমরা তার আদর্শ নিয়েই চলতে চাই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close