জাতীয়নারায়ণগঞ্জ

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা নারায়ণগঞ্জের স্বল্প আয়ের মানুষ

সারাদেশের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা নারায়ণগঞ্জের মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় অনেকটাই বেড়েছে চিনি ও তেলের দাম। তাছাড়া বেশিরভাগ পণ্যই কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে । তাই বাজারে গিয়ে নিজের পকেটের কথা ভেবে ক্রেতাদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

 

শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) শহরের দিগুবাবুর বাজার ও কালির বাজার  ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজ-রসুন, ডিম, ব্রয়লার ও আদার দাম কিছুটা কমলেও বেশিরভাগ পণ্যই এখন কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। তাছাড়া এই দুই বাজারে পণ্যের মানে কোন তফাত না থাকলেও দামে আছে ব্যবধান। বাজারে ঘুরে জানা যায়, এলাকাভেদে কিছু পণ্য দাম দিগুবাবুর বাজারের চেয়ে কালির বাজারে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি।

দিগুবাবুর বাজার:

সবজি বাজার: দিগুবাবুর বাজারে কয়েকটি সবজির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বেশকিছু সবজি কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে। কিছু সবজির দাম কমেছে। তবে প্রতিকেজি ৫০ টাকার কমে কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না।

কয়েকটি  দোকানে শীতকালীন সবজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। দেশি গাজর ১২০ ও চায়না ১৬০ টাকা, দেশি পাকা টমেটোর কেজি ১৪০ এবং ইন্ডিয়ান ১২০ টাকা, কাচামরিচ, পটল, করলা, লম্বা বেগুন, লতি, লাল শাক, পুঁই শাক কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকার ভেদে প্রতি পিস ৫০ থেকে ৬০টাকা। তবে গত কয়েক দিনের ব্যবধানে সিমের দাম ১শ’ টাকা থেকে কমে এখন ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তাছারা পালং শাক প্রতি কেজিতে ২০ টাকা কমে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাউ এর দাম ২০ টাকা বেড়ে আকার ভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে শুক্রবার শসার চাহিদা বেশি থাকায় কেজি প্রতি ১০ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গোল বেগুন বর্তমানে ৯০ টাকা বিক্রি হলেও সপ্তাহ খানিক আগে তা বিক্রি হতো ১৪০ টাকায়। আলুর দাম ২৫ টাকা থেকে প্রায় অর্ধেকের বেশি কমে ১২ টাকা কেজি বিক্রি করছে বিক্রেতা।

এ বিষয়ে দিগুবাবুর বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মো. কবির বলেন, কাঁচামালের নির্ধারিত কোনো মূল্য নাই। কারণ কাঁচামাল পচনশীল, তাই  কখনো ১০/ ২০ টাকা বাড়ে আবার কমে। যেমন ফ্রেশ সবজির দাম একটু বেশি পাওয়া যায়, আবার একটু দাগি বা নিন্ম মানের হলে ব্যবসার চালান তোলা দায় হয়ে পড়ে।

দিগুবাবুর বাজার ঘুরে জানা যায়, আদা, রসুন ও পেয়াজের দামে তেমন কোন পরির্বতন হয়নি। এক সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকা। কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা যায়, পেয়াজের দামে কোন পরির্বতন হয়নি, আগের দামই আছে। দেশি পেয়াজ এক কেজি ১২৫ ও চায়না ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আদার দাম বেড়েছে ৬ টাকা। এক কেজি দেশি আদা কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে ১শ’ ২০ ও চায়না ২শ’ টাকা। রসুন প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে দেশি ৬০ ও চায়না ১২০ টাকা।

নিত্যপণ্যের বাজার:

নিত্যপণ্যের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোটা চাল কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। স্বল্প মানের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিলো ৫২ থেকে ৫৮ টাকা। মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার ওপরে।  মোটা চাল কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে।

এক সপ্তাহ ব্যবধানে দাম বেড়ে  এক কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ১০৮ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। প্যাকেট চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা কেজি। খোলা আটা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায় আর প্যাকেট আটা ৭০-৭৫। এছাড়া দুই কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকাতে। আগে দুই কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হতো ১২০-১২৫ টাকায়। দেশি মসুরের ডালের দাম প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। দেশি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও কেজিতে দাম ছিল ১১০-১২০ টাকা। এছাড়া ১২০-১২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ইন্ডিয়ান মসুরের ডাল।

ভোজ্যতেলের দাম এক লিটার বোতল আগে ছিল ১৭৮ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। ৮৮০ টাকা পাঁচ লিটারের বোতলের দাম এখন ৯২৫ টাকায়। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮৫ টাকা।

দিগুবাবুর বাজারের জনতা ভান্ডারে মালিক গোবিন্দ পোদ্দার বলেন, নিত্যপণ্যের দাম আহামরি তেমন বাড়েনি। এখন পর্যন্ত মোটামুটি আগের দামেই আছে। আর যা বেড়েছে তা পাইকারি বাজারে দাম বেশি, তাই আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এখন বেশি দামে কিনে এনে তো আর কম দামে বিক্রি করতে পারি না।

তার উলটো দিকে থাকা জয় স্টোরের মালিক জয় মজুমদার বলেন, তেল ও চিনির দামে তেমন কোন পরির্বতন হয়নি। বলা যায়, আগের দামেই আছে। তবে সামনে আরও কমতে পারে

মাছের বাজার:

এদিকে মাছের বাজারে দেখা গেছে, প্রায় সব মাছের কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। দাম বেড়ে পাঙাশও ১১০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া ২২০ টাকা, রুই মাছ ৩০০-৩৫০, ছোট কাচকি মাছ প্রতি কেজি ২৮০-৩০০ টাকা, চাষের কই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা, কাতলা ২৮০-৩২০ টাকা ও সিং মাছ ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তাছাড়া ছোট বোয়াল মাছ ৫০০-৬০০ টাকা, ছোট টেংরা ৪০০ টাকা, টাকি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পাবদা ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, চিংড়ি ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, রূপচাঁদা ছোট সাইজের প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা, জাটকা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, এক কেজির ইলিশ ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা ও দেড় কেজির ইলিশ ১৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

মাছ ব্যবসায়ি রবিন বলেন, বাজারে প্রায় সব মাছের চাহিদা বেশি। তবে পাঙাশ, রুই ও ইলিশ একটু বেশি বিক্রি হয়। দামের বিষয়ে তিনি বলেন, যে ভাবে সব জিনিসের দাম বাড়ছে আমরা ১০/২০ টাকা না বাড়াইলে কি করে সংসার চলবে।

মাংসের বাজার:

মুরগীর বাজার কিছুটা কম হলেও কোন পরির্বতন নেই খাসি, বকরি ও  গরুর মাংসের বাজারে।

মাংসের বাজারে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির প্রতিকেজি ১৭০, সোনালী মুরগি ২৮০ থেকে ৩০০, কক ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস প্রতি কেজিতে ৯শ’ থেকে  সাড়ে নয়শ , বকরি ৮শ’,  গরু মাংস ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এসময় মো. বাবুল নামে একজন গরুর মাংস ব্যবসায়ী বলেন, আগের তুলনায় গরুর মাংসের চাহিদা কম। কয়েক বছর আগে আমার প্রতিদিন গরু লাগতো ৭টা খেকে ৮টা এখন জবাই করা হয় ৩টা থেকে ৪টা। কারণ বর্তমানে জিনিসপত্রের যে দাম তাতে মানুষ বেশি গরুর মাংস কিনে না।

তার পাশে থাকা এক খাসির দোকানের কর্মচারী বলেন, খাসির এখন তেমন চাহিদা নাই । কারণ খাসি হলো বড় লোকের খাবার। কারণ প্রতিদিন ১ হজার টাকা কামাই করে ৯শ’ টাকা দিয়ে খাসির মাংস খেলে গরিবের জীবন শেষ হয়ে যাবে । তিনি আরও বলেন, আমরা দোকানে ৪ জন কাজ করি। আগে প্রতিদিন ছাটি (মাংস ও হারের কিছু অংশ) বিক্রি করতাম ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।  কিন্তু এখন প্রতিদিন ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা বিক্রি হয়। আর তা ৪ জন ভাগ করলে কী থাকে। তাই অনেকেই এখন এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যোগ দিয়েছে। কারণ জিনিস পত্রের যে দাম এই বেতনে কাজ করে সংসার চলে না।

ডিমের বাজার:

সাদা ডিম ৫ টাকা কমে বর্তমানে এক হালি বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকায়, লাল ডিমের হালি ৪০ টাকা যা আগে ৪৬ টাকায় বিক্রি হতো, হাঁসের ডিমের দামে কোন পরির্বতন নেই আগের মতই ৭০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে, দেশি ডিম ৬০ টাকা হালি যা আগে বিক্রি হতো ৪৬ টাকায়। কোয়েল পাখির ডিম হালিতে ২ টাকা কমে ১৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিম ব্যবসায়ী ইসলাম মিয়া বলেন, ডিমের দামে তেমন কোন পরির্বতন হয়নি। আগের দামেই আছে। তবে সামনে আরও কমতে পারে

কালির বাজার:

দিগুবাবুর বাজারের সাথে কালির বাজারের বেশির ভাগ পণ্যের দামে এক থাকলেও ডিম, আটা, চিনি, তেল ও চালের দামে রয়েছে হের ফের। প্রতি কেজিতেই দিগু বাবুর বাজারের চেয়ে ২ থেকে ৩ টাকা এখানে বেশি। এ বিষয়ে কালির বাজারে সন্তোস স্টোর, পৃথ্বী স্টোরে ও নারায়ণগঞ্জ প্রেটিন হাউজের মালিকের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা কেউ কথা বলতে রাজি হন নি।

ক্রেতারা বলছেন, জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ,  গোশত, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট, ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে সাধারণ ক্রেতারা এখন দিশেহারা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close