খুলনা বিভাগমতামত

“আমি একটি কলম”

আমি একটি কলম। নির্জীব নিথর ভাবে পড়ে থাকি বলে অনেকেই আমাকে তুচ্ছ ভাবে। আমি কথা বলি না বলে মানুষ ভাবে আমার কোন অনুভূতি নেই, কোন ক্ষমতা নেই। আসলে কি তাই? ফাঁসির রায়ে দন্ডিত আসামি বিচারকের সামনে দাড়িয়ে বুঝতে পারে আমার ক্ষমতা কত! প্রেমের বিষে বিষাক্ত প্রেমিক বোঝে প্রেমিকার চিঠিতে লেখা প্রতিটা অক্ষরে আমার গুরুত্ব কতটুকু! সন্তান জীবনে প্রথম যেদিন স্কুলে যায়, পিতা বোঝে আমার মূল্য কত! মানুষের মনের মাঝে লুকানো ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে উপহার প্রদানে একজন বন্ধু বোঝে আমার সৌন্দর্য কেমন! মানুষের মত আমারও জন্ম হয়েছে একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রের চাপে আষ্টে পিষ্ঠে হয়ে যখন জীবনের রং নানান রঙে পাল্টে ফেলেছি, তখন আমাকে বাঁচতে দেওয়া হয়েছে। তারপর নিষ্ঠুর পিতামাতা নাম মাত্র মূল্যে আমাকে পরের কাছে দান করে দিল। রিক্সা→ ট্রাক→ লঞ্চ → ভ্যানে চড়ে খুলনা শহরের হেলাতলা রোডের একটি দোকানে আমার ঠাঁই হল। আমার জীবনটা অনেকটা মেয়ে মানুষের মত। স্থায়ী ঠিকানা নেই। মেয়েরা যেমন বাবার বাড়ি, শশুর বাড়ি, স্বামীর বাড়ি করে বেড়ায় সেভাবে কাটে আমার জীবনের দিনগুলি। শহরে আমার জন্ম হলেও গ্রামের মানুষের মত জীবন কাটে আমার। অনিদ্রা, অবহেলায় পড়ে রইলাম খুলনার শহরের একটি স্টেশনারি দোকানে। তারপর একদিন আমার ভাগ্যে সুসময় এল। একটি গ্রাম্য সাদাসিধে মেয়েকে নববধুর সুন্দর সাজে সজ্জিত করে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়, খুলনা বন্ধুসভার যুথী আপু আমাকে ঠিক তেমনিভাবে অলংকৃত করে তুললেন। বাড়িতে নিয়ে এলেন, একটি সুন্দর মোড়কে ঢুকিয়ে টেবিলের উপর রাখলেন। রাতের বেলায় আমার গায়ে আরো সুন্দর কিছু মোলাট লাগালেন। আমার কি যে ভাল লাগা কাজ করছিল! তারপর ঘটল আরো মজার ঘটনা। লিমা আপুর ব্যাগে আমার জায়গা হল। জায়গা ঠিক ব্যাগে বলা উপযুক্ত হবে না, লিমা আপুর মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলাম। কারণ আমি ছিলাম লিমা আপুর জন্মদিনের উপহার। এই প্রণয় আমার পরিণয় এনে দিয়েছিল। আমি রাতের বেলায় লিমা আপুর প্রেমিকের দেওয়া ডাইরির বুকে গড়াগড়ি দিতাম, সকাল বেলায় হাসপাতালে মুহূর্ষূ রোগীর জীবন বাঁচানোর কাজে লাগতাম, কখনো কখনো লিমা আপুর ব্যাগের মধ্যে নিরাপত্তার অস্ত্র হিসেবেও নিজেকে কল্পনা করতাম। এরপর……. একদিন হঠাৎ ব্যস্ততার মাঝে আমি চলে গেলাম প্রথম আলোর নন্দিত সাংবাদিক শেখ আল এহসান ভায়ের বাহুডোরে। নিজের জীবনকে স্বার্থক মনে হচ্ছিল। কারণ তখন আমি আর পরিবার বা অঞ্চলে নয়, জাতীয় দৈনিকে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছি। আমার কালি দিয়ে লেখা রিপোর্ট জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। মনুষ্য সমাজের যত অনিয়ম – অসংগতি তুলে ধরা কিংবা ভালো কাজের সঙ্গী হয়ে সমাজকে আলোকিত করার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সার্থক করে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। আমার ভাগ্যে সুখ কখনো স্থায়ী হয়নি। শেখ আল এহসান ভাই আমার উপর এত বেশি কি কারণে বিরক্ত হয়ে উঠলেন আমি ঠিক জানি না। আমাকে মোবাইলের ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে সে ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করলেন। আমাকে আবার পিছনে ফিরতে হল। তারপর একদিন আমার ভেতরের সমস্ত কালি ফুরিয়ে গেল, উপযোগিতা শেষ হল আর হস্তপেশির সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আমাকে ছুঁড়ে ফেলা হল একটি ডাস্টবিনে, তারপর নর্দমায়। মনুষ্যগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালীও বুঝি এরকম? যৌবনে আঁকাশ ছোয়া স্বপ্ন, সিংহের ন্যায় পেশি শক্তি আর বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রম অথবা কোন এক ঘরের কোণায় আশ্রয়! তারপর……… দেহের নশ্বরতা। এই জীবনের ধাবমানতা আমাকে নিদারুণ একটা শিক্ষা দিয়েছে। যতদিন মানুষের কাজে এসেছি, শেষ কালিবিন্দু পর্যন্ত আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে বহুবার। অসংখ্য মানুষের প্রয়োজন হয়েছি আমি, কিন্তু হায় আফসোস! উপযোগিতা শেষের পর সুন্দর কোন কলমদানি বা আলমারিতে আমি কারো প্রিয়জন হয়ে থাকতে পারলাম না!!!

লেখক:

এম, এম, মাসুম বিল্যাহ ছাত্র, সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close