আন্তর্জাতিকরাজনীতি
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছেন ইরাকের মানুষজন

সম্প্রতি বাগদাদে ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। ইরাকের মানুষজন পথে নেমে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও শুরু করেছেন। ইউক্রেনে রুশ হামলার ফলে এক লাফে খাবার জিনিসপত্রেরও দাম বেড়েছে। কিন্তু ডিজেলের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
তেলের পাম্প থেকে এসি এবং ফ্রিজ–সবকিছু চালাতে জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সরকার চালিত গ্রিডগুলি কাজ না করলে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের প্রয়োজন হয়। তবে যে হারে ডিজেলের দাম বাড়ছে, এর ফলে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন সাধারণ মানুষ।
বাগদাদের সাংবাদিক খলউদ রামেজি বলেন “ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে। গরমকালে সমস্যা আরও বাড়বে। এক অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুতের জন্য গত মার্চে দিয়েছিলাম ৮৬০ টাকা। এই মার্চে দিতে হল প্রায় ১৪০০ টাকা। গরমকালে এই বিল আরও বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
বেইরুটের স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াসিম-আল-শাব বলেন, “রুটি না কিনলেও চলবে। অন্য কিছু খেয়ে নেব। যে রকম গরম, যে পরিমাণে দূষণ রয়েছে এখানে, গরমকালটা কেমন করে সহ্য করব জানি না। ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে।”
সহায়তা জরুরি
ইরাক এবং লেবাননের মতো দেশে বিদ্যুতের দামের সঙ্গে ডিজেলের দামের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের বাসাবাড়িতে যে জেনারেটর আছে তার জন্য নির্ভর করতে হয় ডিজেলের উপর। কিন্তু জ্বালানি বন্ধ হলে সাধারণ সময়েও বিদ্যুৎ পরিষেবায় ঘাটতি দেখা যায়।
সরকারচালিত পাওয়ার গ্রিডগুলির ক্ষমতা সীমিত হওয়ার কারণে স্থানীয়রা অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দিনে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। তাই বেসরকারি সংস্থার থেকে ডিজেলচালিত জেনারেটর নিতে হয়। হাসপাতাল বা আবাসনের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তাই ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেনে বিদ্যুতের দাম বেড়ে চলেছে ক্রমশ।
এদিকে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে কী হবে, তা নিয়ে আশঙ্কিত সাধারণ মানুষজন। ডিজেলের দামের সঙ্গে মানুষের মরা-বাঁচা নির্ভর করছে বলেই মনে করছেন তারা। নতুন করে এই ভূখণ্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
বিশ্ববাজারে কী অবস্থা?
রুশ হামলার আগে থেকেই ডিজেলের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কোভিড লকডাউন শেষ হওয়ার পর সরবরাহ সংক্রান্ত জটিলতা এবং (উৎপাদন এবং বহন) পরবর্তীতে বিপুল চাহিদার কারণে ডিজেলের দাম বেড়ে যায়। শক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রাবন্ধিক জাভিয়ের ব্লাসের মতে, “ইউক্রেন সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।”
বিশ্বের বেশিরভাগ ডিজেলের উৎস মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ। সারা বিশ্বের একটা বড় অংশে ডিজেল সরবরাহ করে সৌদি আরব। এর ফলে স্থানীয়রা একেবারে ন্যূনতম দামে তা কিনতে পারেন। তবে সব দেশের অবস্থা এক নয়৷লেবানন, জর্ডন, ফিলিস্তিনের কিছু অংশের পুঁজি খুবই কম।
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনাস আবদুন এই প্রসঙ্গে বলেন, “ইরাক ডিজেল উৎপাদন করে কিন্তু তাতে স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্থানীয় সংশোধনাগারগুলি ঠিকমতো কাজ করে না। সরকার কোনো কোনো দেশে ভর্তুকি চালু করলেও বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে এতে কোনোরকম লাভ হয় না।”
লেবাননের সংকট
বাগদাদের সাংবাদিক রামেজির কথায়, “সরকার দৈনিক দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু গরমকালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তেলের পাম্প আর এসির চাহিদা বাড়বে। সরকারচালিত পরিষেবার পক্ষে বিদ্যুতের বিপুল বোঝা টানা সম্ভব নয়। গরমকালে ধনী ব্যক্তিরা বিদ্যুতের জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে পারবেন, গরিবেরা পারবেন না।”
ইরাকের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। কতক্ষণ বিদ্যুৎ চান সেই বুঝে বেসরকারি জেনারেটর সংস্থাকে টাকা দেন সাধারণ মানুষ। ২৪ ঘণ্টার জন্য ১০ অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুতের টাকা দিতে পারলে সারাদিন বাড়িতে এসি চালানো সম্ভব হয়।
রামেজি বলেন, “নিম্ন আয়ের পরিবারগুলির পক্ষে বিদ্যুতের এত খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তারা খুব বেশি হলে সারা দিনে তিন অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুতের টাকা দিতে পারে। এর ফলে তারা দিনের বেলা ফ্যান চালাতে পারে অথবা রাতে ঘুমানোর সময়টুকুর জন্য সচল বিদ্যুৎ পরিষেবা পেতে পারে।”
হেইনরিখ বওল ফাউন্ডেশনের তরফে অ্যানা ফ্লেইশার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, লেবাননের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ পরিষেবার প্রায় পুরোটাই বেসরকারি সংস্থার উপর নির্ভরশীল৷ অর্থাৎ বিদ্যুতের বেশিরভাগটাই জেনারেটর থেকে আসে। ডিজেলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন তিনিও।
তার কথায়, “ডিজেলের দাম যত বাড়বে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। তারা আর জেনারেটর ব্যবহার করতে পারবেন না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাও তো গরমে থাকতে পারবেন না।”
বেইরুটের স্থানীয় বাসিন্দা শিরিন খৈয়াত বলেন, “একটা সময় গরমকালে কত বয়স্ক মানুষ কষ্ট পেয়েছেন বলে শুনেছি। ডিজেলের খরচ দিতে না পারায় তাদের অক্সিজেন মেশিনটা পর্যন্ত কাজ করত না। এমন পরিস্থিতি দেখতে চাই না।”
ডিজেলের খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে গোটা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গরমকালে গত কয়েক বছর ধরে এই কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে ইরাকে। বিদ্যুৎ পরিষেবা না থাকায় একাধিক কাজ ব্যাহত হয়েছে। ক্ষোভের ফলে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ মানুষ। গত বছর বাসরা প্রদেশে তাপমাত্রার পারদ ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। ২০১৫ সাল থেকেই গরমকালে বিক্ষোভ বাড়ছে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে। ২০১৮ সালে শুধুমাত্র এই কারণে একাধিক সহিংসতার ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরাক।
বাগদাদের সাংবাদিক রামেজির বক্তব্য, “মারাত্মক গরম সহ্য করতে না পারলে মানুষ কী করবে?” অথচ বাসরা প্রদেশই ইরাকের তিন চতুর্থাংশ তেল সরবরাহ করে।
লেবাননের স্থানীয় বাসিন্দা আল শাব বলেন, “খাবার কম খেয়ে ডিজেলের জন্য, ফ্রিজের জন্য খরচ বাঁচিয়ে রেখেছিলাম গত বছরে। কিন্তু দাম যে হারে বেড়ে চলেছে, ফ্রিজ যদি চালু না থাকে, খাবার এমনিতেও পচে যাবে।”